গুলেন মুভমেন্ট : মুসলমানদের পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনে এক নতুন ধারা

( কপি করে  এখানে রেখে দিলাম। পাঠকগণ পড়ুন, তবে গুলেনকে আরো জানতে হবে, আমি তার সমর্থক নই বরং তাকে সন্দেহের চোখে দেখি। আরো ব্যাপক পড়াশুনার জন্য নিজের ব্লগে কপি করলাম।)

পরিবর্তনশীল সমাজ ও বিশ্বের অনেক কিছুই ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবন ও জগত সম্পর্কীয় মৌলিক বিশ্বাসের পরিবর্তন না ঘটলেও মৌলিক বিশ্বাস কেন্দ্রিক কার্যসমূহের ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে অনুধাবন ও বাস্তব জীবনে পরিপালনের প্রক্রিয়াটি বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজে বিবর্তনশীল। আর তাই ইসলামকেন্দ্রিক বিষয়সমূহের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করি। বিগত চার দশকে তুরস্কে ইসলামপন্থী আন্দোলনের কার্যাবলী প্রখ্যাত দার্শনিক, আলেম, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক ফেতুল্লাহ গুলেন এর হাতে অভিনব রূপ ও কৌশল পরিগ্রহণ করেছে। ফেতুল্লাহ গুলেনের সাথে তাঁর সহকর্মীদের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ও কার্যকৌশল বিশ্বাসীর নিকট “গুলেন মুভমেন্ট” নামে পরিচিত। তুরস্কে ইসলামপন্থী একে পার্টির ক্ষমতায়ন এবং দীর্ঘ ১০ বছরব্যাপী চরম সমাজতান্ত্রিক ও নাস্তিক্যবাদী সামরিক বাহিনীকে মোকাবেলা করে এরদোগান ও আব্দুল্লাহ গুলের সরকার পরিচালনার নেপথ্যে রয়েছে এই গুলেন মুভমেন্টের ব্যাপক অবদান। এই প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্যাপী ফেতুল্লাহ গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টকে নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ। ফেতুল্লাহ গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের সাথে প্রাথমিকভাবে পরিচিত করানোর জন্য আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
ঐতিহাসিক পটভূমি :
গুলেন মুভমেন্ট হচ্ছে একটি সামাজিক আন্দোলন (Civil society movement)। তুরস্কের ইজমির নগরীর প্রচারক ফেতুল্লাহ গুলেন এবং তার চারপাশের একদল ত্যাগী, নিষ্ঠাবান ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক এবং স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একটি সামাজিক সেবা প্রদানকারী গ্রুপ হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই গুলেন মুভমেন্টের। পশ্চিমা স্কলারদের নিকট, এককথায়, এটি গুলেন আন্দোলন (গুলেন মুভমেন্ট) হিসেবে পরিচিত। গুলেন মুভমেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের নিকট এটি হিজমেত বা ‘স্বেচ্ছাসেবী আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিত। ফেতুল্লাহ গুলেন এই আন্দোলনকে ‘মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একদল লোকের আন্দোলন’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
মুসলিম-বিশ্বাসভিত্তিক আন্দোলন হিসেবে এটি ১৯৬০ সালের দিকে যাত্রা শুরু করে। আর এই উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ছাত্র-বৃত্তি, ছাত্রাবাস, স্কুল-কলেজ এবং কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষা-সেবা নিয়ে। বিগত চার দশকের মধ্যে এটি জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে এটি শিক্ষাক্ষেত্র হতে আন্তঃসাংস্কৃতিক, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। বর্তমানে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক মিলিয়নে। গুলেন মুভমেন্টের অনুসারীদের রয়েছে শত শত ফাউন্ডেশন, কোম্পানি, পেশাজীবী সংগঠন এবং অসংখ্য আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সামাজিক সংগঠন ও সংস্থা।
প্রথম দিকে গুলেন মুভমেন্টের কাজ শুরু হয় মূলত ছাত্র-শিক্ষক, স্থানীয় অধিবাসী এবং বিভিন্ন সভা-সমিতি, সেমিনার ও ক্যাফে-কর্নারে ফেতুল্লাহ গুলেনের খোলা প্রশ্নোত্তর পর্বে যারা অংশগ্রহণ করতো তাদের মাধ্যমে। আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে গুলেন ইজমির শহরের একটি ছাত্রাবাস কাম কোচিং সেন্টারে ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। ফেতুল্লাহ গুলেন মুভমেন্টের প্রাথমিক উন্নয়নে এই ‘কিস্তানি পাজারি’ ছাত্রাবাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গুলেন ছিলেন একজন সরকারি ধর্ম-প্রচারক। তিনি ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি অংশ নিতেন নানা গণবক্তৃতায়। তাছাড়াও গুলেন অংশ নিতেন যেকোনো ক্যাফে-কর্নারে ও চা-চক্রের আড্ডায়। এই সকল পরিবেশে আলোচনা চলত সুশিক্ষার জন্য আবশ্যকীয় নানা অনুসঙ্গ এবং প্রয়োজনীয় নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে। আর এই আলোচনাই গুলেন ও তার চারপাশের লোকজনকে সামাজিক সামষ্টিক মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। এই আলোচনা ও পর্যালোচনার ফলেই পরবর্তীতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের মাধ্যমে গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। আর এই সব প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম শিক্ষাভিত্তিক; যেমন- ছাত্রবাস, কোচিং সেন্টার, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর কলেজ প্রভৃতি। পরবর্তী সময়ে মিডিয়াভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে এই সকল মিডিয়া গড়ে উঠেছিল শিক্ষা উদ্যোগের অনুবর্তন হিসেবে। আরো পরের দিকে, সমমনা ও সমপেশার লোকদের নিয়ে গড়ে ওঠে নানা পেশাজীবী, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আশির দশকের শেষ দিকে তুরস্কে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের লালন সামরিক শক্তির লৌহশাসনের অবসান ঘটে। ঠিক একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে এবং মধ্যএশিয়ায় অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এই সময় গুলেন মুভমেন্ট দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পর মধ্যএশিয়ার সকল সদ্য স্বাধীন মুসলিম দেশে গুলেন মুভমেন্ট তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। তুর্কি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীভুক্ত এসব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি গুলেন মুভমেন্ট আন্তঃসাংস্কৃতিক ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ শুরু করে। হান্টিংটেনের “সভ্যতার সঙ্কট” এর বিপরীতে ফেতুল্লাহ গুলেনের এই “আন্তঃধর্মীয় সংলাপ” সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়।
যদিও এন্টার্কটিকা ব্যাতীত বাকী সকল মহাদেশেই গুলেন মুভমেন্টের কাজ সম্প্রসারিত হলেও এর কোনো নিবন্ধিত অফিস বা ঠিকানা নেই। তুরস্কের সকল শহর ও নগরীতে গুলেন মুভমেন্টের দ্বারা অনুপ্রাণিত স্কুল কিংবা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছড়িয়ে রয়েছে। তুরস্কের বাইরেও সকল মহাদেশ জুড়ে শত শত স্কুল ছড়িয়ে আছে। আর এ সকল স্কুল গুলেনের শান্তিপূর্ণ জীবন ও কর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ১৯৬০ সালে গুলেনের কতিপয় শিষ্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ২০০০ সালে লাখ লাখ মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকেরই গুলেনের সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। এটা সত্যিই আশ্চর্যের যে, কিভাবে এটা ঘটল? গুলেন মুভমেন্ট এর কোন্ বিষয় তুরস্কের জনগণকে এতটা আকৃষ্ট করল?
গুলেন মুভমেন্টের বাণী ও তার মূল আকর্ষণ :

ষাটের দশকের শেষ দিকে এবং সত্তরের দশকের প্রথম দিকে গুলেন দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে/বিপরীতে বাস্তবজীবনীভিত্তিক গভীর বিশ্বাস ও মানবসেবার প্রচার শুরু করেন। সে সময় গণতন্ত্রের ওপর অগণতান্ত্রিক বাধা, জনজীবনে ধর্মীয় আচার পালনে বাধা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংঘর্ষ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সুন্নী ও আলভী, তুর্কী ও কুর্দি, নিষ্ঠাবান ও সেক্যুলার মুসলিম নাগরিকদের মাঝে উত্তেজনা ছিল চরমে। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী, ফ্যাসিস্ট ও ধর্মীয় চরমপন্থীদের মাঝের রাজনৈতিক ও আদর্শিক সশস্ত্র সংঘাত তুরস্কের রাস্তাঘাটে হাজার হাজার যুবকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়াও তথাকথিত আধুনিকতাপন্থী ও ঐতিহ্যবাদপন্থীদের মাঝে বিরাজমান চরম উত্তেজনা ও অন্যান্য অনেক সমস্যা মিলে তুরস্কের শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলেছিল। আর এসব কারণে ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও গোটা মানবতাকে নিয়ে গুলেনের সামগ্রিক চিন্তাধারা তাঁর শ্রোতাদের নিকট একটি আবেদন সৃষ্টি করেছিল। দারিদ্র্য, পারস্পরিক শত্রুতা (বিশেষ করে ধর্মবিভেদ), সুশিক্ষার অভাবকে গুলেন এসব সমস্যার মূল কারণ হিসেবে সনাক্ত করেন। আর এর সমাধান হিসেবে গুলেন নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন এবং তার অনুসারীদের শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেন :
১. আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে একজন গভীর বিশ্বাসী এবং সে বিশ্বাসের বাস্তব অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলা।
২. শুধু নিজের সেবা না করে অন্যদের সেবার চিন্তাও করতে হবে; শুধু নিজের কথা চিন্তা না করে মহৎ ভিশন নিয়েও ভাবতে হবে। তিনি সচেতন যুবক ও জনগণকে প্রশ্ন করলেন, কেন আরো সমৃদ্ধ তুরস্ক চাইবে না? কেন শান্তিপূর্ণ মানবতা কামনা করবে না?
৩. অজ্ঞতা, ধর্ম-বিভাজন, দারিদ্র্য ইত্যাদি যে সকল সমস্যা জাতিকে পঙ্গু করছে তার প্রধান কারণ মৌলিক শিক্ষার অভাব। আর শিক্ষাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সবার আগে দরকার নিষ্ঠাবান শিক্ষক ও প্রশাসক যারা মানুষের কাংখিত মূল্যবোধ ছাত্রদের সামনে পালনের মাধ্যমে তুলে ধরবে। কাজেই শিক্ষায় বিনিয়োগ করুন। তিনি আহ্বান জানালেন, যদি আপনি একজন ব্যবসায়ী হন তাহলে কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করুন। যদি আপনি সন্তানের জনক-জননী হোন, তাহলে সন্তানদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করুন এবং আপন আপন এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন। আপন পরিসরে প্রত্যেকেই সহায়তা করুন ‘শিক্ষা-প্রকল্প’ বাস্তবায়নে। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রকল্প যেমনঃ মিডিয়া, স্বাস্থ্যসেবা, আকস্মিক বিপর্যয়ে সহায়তা দান, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি চালু হয়েছিল এবং জনগণের নিকট আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
৪. সবকিছু সরকারের নিকট থেকে চাইবেন না। নাগরিক দায়িত্ববোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন এবং কখনো নিজের দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। গুলেনের এই আহ্বান জন এফ কেনেডির সেই বিখ্যাত উক্তিরই যেন নতুন এক প্রতিধ্বনি ‘‘প্রশ্ন করবে না রাষ্ট্র তোমার জন্য কি করতে পারে? বরং প্রশ্ন করবে তুমি রাষ্ট্রের জন্য কি করলে?’’
যদি আপনি ব্যবসায়ী হোন তাহলে নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করুন, বিভিন্ন পার্টনারশিপ ও হোল্ডিংস গঠন করুন, অর্থ আয় করুন এবং উদারহস্তে দান করুন। কোনো পার্থিব প্রতিদান আশা না করে মানব সমাজের দায়িত্ব পালন করুন।
৫. পৃথকীকরণ, বর্ধনীকরণ এবং জনজীবনের ঘটনায় প্রতিক্রিয়াশীল না হয়ে সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করুন। বিচারবিভাগ, শাসনবিভাগ, সামরিক বাহিনী, মিডিয়া, শিল্পকলা ও ব্যবসা সর্বত্রই সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করুন। দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকরা এসব প্রতিষ্ঠানগুলো “ধর্মবর্জিত গুণাবলী” সম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করেছে। তারা তাদের সন্তানদের শুধুমাত্র মাদরাসা এবং ইমাম হাতিফ স্কুলে প্রেরণ করছে। ফলে তাদের প্রত্যাশা কিংবা বিশ্বশিক্ষা অবমূল্যায়িত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
৬. ধর্ম, আধুনিকতা, দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, কলা, সেক্যুলারিজম এবং অন্যান্য ফলপ্রসূ কার্যাবলীর একটি সুসমন্বিত সংশ্লেষণ হচ্ছে না। বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে ইসলাম ধর্মের একটি অত্যুচ্চমানের ধারণার বাস্তব নমুনা তিনি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে উপস্থাপন করেন।
৭. তিনি অন্তর্ভুক্তিকরণ (Inclusive), সুদূর প্রসারিত ও ঐক্যের প্রতীক হবার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ব্যক্তি হতে কমিউনিটি, কমিউনিটি হতে জাতীয়, জাতীয় হতে আন্তর্জাতিক এবং আন্তর্জাতিক হতে পুরো মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রচার করেন।
গুলেন মুভমেন্টের সফলতার পেছনে যে সকল নিয়ামক কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে :

(i) কেন্দ্রীয় ধারা : নৃতাত্বিক পরিচয়, সংস্কৃতি, ধর্ম, সামাজিক শ্রেণী এবং সহিংসতার বিপক্ষে অবস্থানকারী ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গীর বিবেচনায় আন্দোলনের অংশীরা ছিলেন সমাজের মূলধারার লোকজন। আন্দোলনে যোগদান কিংবা নির্গমন ছিল পুরো স্বাধীন ও স্বেচ্ছাধীন। এটি ছিল একটি উন্মুক্ত প্রকল্প যেখানে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে। অংশগ্রহণ কিংবা বিযুক্তিকরণ পুরোটাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত।
(ii) আন্দোলনের অংশীদের কিছু মূলনীতি সাধারণ নাগরিকদের নিকট ছিল খুবই আকর্ষণীয়। এগুলো হলো :
(ক) মানবকল্যাণমূলক চিন্তার উপস্থিতি এবং আত্মসেবা ও আত্মপূজার অনুপস্থিতি। গুলেন নিজে কোনো সম্পদ অর্জন না করে এবং নিজের আত্মীয়দের অর্থ-সম্পদের পিছনে ধাবিত হতে অন্যুৎসাহিত করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
(খ) বিশ্বাস এবং স্বাধীনতা- আন্দোলনের কোনো পর্যায়েই কোনো অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, বৈদেশিক সাহায্য কিংবা অনুদান ছিল না।
(গ) প্রচলিত আইন অনুসরণ একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত না করে রাষ্ট্রকে সম্মান এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতি ও অত্যাচার সত্ত্বেও গণতন্ত্রের বিকাশের প্রতি কমিটমেন্ট এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের অংশীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
(ঘ) অন্য একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- নির্দলীয় অবস্থান। রাজনৈতিক কোনো কারণ বিবেচনায় আন্দোলনের মাঝে কোনো বিভাজন ছিল না। আন্দোলনের ছিল একটি সর্বব্যাপী প্রেক্ষিত যেখানে যে কোনো নাগরিককে দেখা হয় ভবিষ্যতের একজন সম্ভাবনাময়ী অংশী হিসেবে। ফেতুল্লাহ গুলেন নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
আদর্শ ও মূল্যবোধ :

গুলেন যে আদর্শ ও মূল্যবোধের ধারণ, লালন করেন ও প্রচার করেন তা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখা এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায় : গভীর বিশ্বাস, পরার্থবাদ, সাম্য, সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা, আশা, বিনম্রতা, সৌজন্য, সহানুভূতি, যুক্তিবোধ, আধ্যাত্মিকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা।
গুলেনের আলোচনার বিষয়বস্তুগুলোও বেশ চিত্তাকর্ষক। যেমন : সামাজিক সুবিচার (Social Justice), নৈতিকতা ও সদাচরণ (Ethics & Morality), পরিবার ও শিশুশিক্ষা (Family & Child education), আনুষ্ঠানিক ইবাদত (Ritual prayer), পরকালীন জীবন (After life), কুরআনের দৃষ্টিতে অধিবিদ্যামূলক বিশ্ব (Metaphysical world in the light of Quran),  মানবতাবোধ জাগ্রতকারি গুণাবলী (Virtues that elevate Humanity), রাসূলের (সা.) জীবনী (Life of prophet Mohammad), হজ্জ (Pilgrimage), ভাগ্য ও স্বাধীন চিন্তা (Destiny & Fire Will), রোজা (Fasting), স্রষ্টার দূতসমূহ (Messengers of God), যাকাত (Zakah charitable giving), আল্লাহর একত্ববাদ বিশ্বাস (Believe in the One ness of God), অন্তররাজ্য (The world of the Heart), কুরআন ও বিজ্ঞান (Quran & Science), ব্যবসা, অর্থনীতি ও মিতব্যয়িতার ব্যাপারে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গী The state of our Goals. গুলেনের লেখার একটি সংলকলনÑ যাতে এসব বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে।
গুলেন মুভমেন্টের অংশীদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত, কার্যক্রম, প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনসমূহ :

ফেতুল্লাহ গুলেনের আলোচনা, লেখা ও কার্যক্রম দেখে তার অনুসারীরা উৎসাহিত হয়ে গড়ে তুলেছে নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানি। এসব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত রয়েছে শিক্ষা, মিডিয়া, স্বাস্থ্যসেবা, বিপর্যয়কালীন সাহায্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্য। এসকল প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই বিকেন্দ্রীকৃত। একক কোনো সংগঠনের চারপাশে এরা ঘনিষ্ঠভাবে অঙ্গীভূত নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ :

গুলেনের জীবন ও কর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বব্যাপী প্রায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ‘ক-১২’ স্কুল (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর কলেজ), কোচিং সেন্টার, রিডিং রুম, লাইব্রেরি (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আদলে) ইত্যাদি। এগুলোর সিলেবাসে কোনো ধর্মীয় বই নেই। নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান সীমাবদ্ধ নয়। এগুলোর সবই সেক্যুলার ধারার সিলেবাসভুক্ত স্কুল। আর এসব স্কুলের উদ্যোক্তা হলেনÑ স্থানীয় ব্যবসায়ী, পরহিতব্রতী বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা। সকল জায়গার সব স্কুলই বৈরিতামুক্ত, আন্তঃধর্মীয় সহমর্মিতা ও বহুধাভিত্তিক সংস্কৃতির একেকটি নমুনা। এসব স্কুল বিশ্বাস ও যুক্তির সুসমন্বয়ে এবং গোষ্ঠী মানবতার সেবায় নিয়োজিত।
মিডিয়া ও প্রকাশনা :

তুরস্কে গুলেন মুভমেন্ট প্রভাবিত প্রায় ২০টি প্রকাশনা কোম্পানি রয়েছে। এ সকল প্রকাশনা বিভিন্ন ভাষায় তাদের বই-পত্র প্রকাশ করে এবং শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তুরস্কে এ সকল প্রকাশনার বিশাল প্রভাব রয়েছে। তুরস্কে গুলেন প্রভাবিত অনেকগুলো স্থানীয় ও জাতীয় টিভি এবং রেডিও স্টেশন রয়েছে। এসবের মধ্যে Samanyolo TV হচ্ছে অন্যতম যা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুলেন প্রভাবিত টিভি চ্যানেল হচ্ছে চ্যানেল Ebru TV. গুলেন প্রভাবিত নিউজ পেপারের মধ্যে জামান নিউজ পেপার বিখ্যাত। এটি তুরস্কের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা এবং প্রায় ২৫টি দেশ হতে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে Aksiyon। অন্যতম নিউজ এজেন্সি হচ্ছে Cihan News Agency (CNA) যা বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। এছাড়াও গুলেন প্রভাবিত মাসিক পত্রিকা হচ্ছে Sizinti যা ১৯৭৯ সাল হতে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এর প্রায় ১০ লাখ কপি বিক্রি হয় এবং এটি তুরস্কের সর্বাধিক বিক্রিত পত্রিকা। ইংরেজি ভাষাভাষী দেশসমূহে প্রকাশিত গুলেন প্রভাবিত পত্রিকা হচ্ছে The Fountain- যা বিজ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয়ের ওপর লিখিত।
ত্রাণ সাহায্য এবং মানবতাবাদী সেবা :

গুলেনের উৎসাহে একটি রিলিফ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ‘Kimse Youmu?’ বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী মানবতার সেবায় নিয়োজিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুনামি, বাংলাদেশের বন্যা, পাকিস্তান ও পেরুর ভূমিকম্প, দারফুরের নৃতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক সহিংসতায় এটি বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দারফুরের অনেক গ্রামে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল পুনঃনির্মাণ ও মেডিকেল কিনিক স্থাপনের দায়িত্ব নিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা : হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা।
পেশাজীবী সংগঠন : সাদা, নীল ইত্যাদি সংগঠন।
ব্যবসায়ী সংগঠন : ছোট-বড় সকল শহরেই রয়েছে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠন।
রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতি :
গুলেন মুভমেন্টে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুকরা নানাভাবে এখানে অংশগ্রহণের নীতিমালা জানতে পারে। যেমন- আন্দোলনের সাথে জড়িত যে কোনো ব্যবসায়ী, নারী বা অন্য যে কোনো অংশীর মাধ্যমে। ১. আন্দোলনের অংশীরা সাধারণত সপ্তাহে এক দিন চা পার্টিতে অংশ নেয় এবং কোনো না কোনো আত্মিক, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা করে। ২. কলেজ, কোচিং সেন্টার, ছাত্রাবাসের ছাত্র কিংবা শিক্ষকদের সাথে কথা বলে। ৩. আন্দোলনের পেশাজীবী সংগঠনের কোনো সদস্যের সাথে কথা বলে। ৪. আন্দোলনের প্রকাশিত প্রকাশনা, অডিও ক্যাসেট, ভিডিও ক্যাসেট এবং অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে। যেমন- STV, National TV Chanel, Local TV Chanel, Zaman Newspers, radio Stations. 5. ‘Kimse Yokmu’র মাধ্যমে পরিচালিত দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য সেবা, বৃত্তি প্রদান কার্যকলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে।
তহবিল উত্তোলন কৌশল (Fund Raising Mechanism) – Himmet :
গুলেন মুভমেন্ট যে কোনো সরকারি অনুদান ও বিদেশী সাহায্য হতে দূরে থাকে। এতে আন্দোলনের স্বকীয়তা ও নাগরিক বৈশিষ্ট্য (সিভিক ন্যাচার) অুক্ষুন্ন থাকে। আন্দোলনের প্রধান তহবিল যোগান কর্মসূচি হলো হিমেত (Himmet)। যার ইংরেজি অর্থ হলো ডোনেশন প্লেজ (চাঁদার প্রতিজ্ঞা)।
এটি অনেকটা পশ্চিমাদের ডিনার অনুষ্ঠানে ফান্ড উত্তোলন কর্মসূচির ন্যায়। এটি সাধারণত হয়ে থাকে রমজান মাসে। এই অনুষ্ঠানে অংশীরা প্রতিজ্ঞা করে যে কে/কারা কোন প্রতিষ্ঠানে দান করবে।
তহবিল সংস্থানের অন্যান্য পদ্ধতি : অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তির জন্য দান, কুরবানির পশু দান, মহিলাদের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত অন্যান্য পদ্ধতি।
চাঁদা :

এটি অনেকটা আবশ্যকীয় যে, প্রত্যেক সদস্যই তাদের সময় ও সম্পদের কিছু না কিছু আন্দোলনে অবশ্যই দান করবে। একজন ব্যবসায়ীর জন্য আদর্শ হচ্ছে লাভের ১০%। এটা হতে পারে ১ মিলিয়ন ডলার কিংবা তার চেয়ে বেশি বা কম। এর বাইরে ব্যবসায়ীরা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের নিকট আন্দোলনের প্রকল্প ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করে। আন্দোলনের একজন ‘ব্লু কলার’ কর্মীকে দিতে হয় ৫% অর্থাৎ মাসে ৫০ ডলার। কাউকে এখানে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয় না। সকল দান বা চাঁদাই হচ্ছে স্বেচ্ছাকৃত। যে চাঁদা যে প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয় সে প্রতিষ্ঠানে সে চাঁদার হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। এর বাইরে সংগঠনের কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি বা হিসাব সংরক্ষণ বহি নেই। এখানে অংশগ্রহণ হচ্ছে স্বতঃপ্রবৃত্ত এবং এখানে কোনো সদস্য পদ সিস্টেম নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা অংশগ্রহণ করে আর্থিক অনুদান এর মাধ্যমে, আন্দোলনের কাজে সময় দানের মাধ্যমে, মহিলাদের চালিত ‘কর্মেস’ (Kermes) সংস্থার মাধ্যমে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বা ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে, নিজেদের বাসায় অন্যান্য অতিথির বা মিটিং আয়োজনের মাধ্যমে।
গুলেন মুভমেন্টের বিকাশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারণার ভূমিকা :

গুলেন মুভমেন্ট মাত্র ৪ দশকের মধ্যেই মাত্র কয়েকজনের সংগঠন হতে লক্ষ-কোটি মানুষের সংগঠনে পরিণত হয়েছে। গুলেন মুভমেন্টের এই সফলতাকে তুলনা করা যেতে পারে ‘ক্রিস্টালাইজেশন ইফেক্ট’ এর সাথে। কারণ গুলেন এই মুভমেন্টের মাধ্যমে যে আদর্শ বা মূল্যবোধ প্রচারের কাজ করছিলেন তা তুরস্কের জনগণের নিকট একেবারেই নতুন এমন নয়। তুরস্কের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিকট গুলেনের প্রচারিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস, পরার্থবাদ, আলাপ-আলোচনা, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধ (ব্রাদারহুড এন্ড সিস্টারহুড), সমাজ-কাঠামোর উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালানো প্রভৃতি। ইসলামের সর্বশেষ নবী (সা.)-এর জীবন ও কার্যের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় তুরস্কবাসীর নিকট এগুলো খুবই পরিচিত ছিল। এমনকি গুলেনের প্রতিষ্ঠিত ‘সোহবেত’ ও ‘হিমেত’ এর মতো সংস্থা ও সংগঠনও তুর্কিবাসী মুসলিমদের নিকট একেবারে নতুন সৃষ্টি নয়। এগুলোর রুট নিহিত রয়েছে মুসলিমদের ধর্মীয় কালচার জাকাত, সাদকাহ, কর্জ-ই-হাসানা, প্রতিবেশীদের হক আদায় প্রভৃতি কার্যের সাথে যা গুলেনের কাজকে একটি গতিশীল অবস্থা দান করে।
গুলেন মুভমেন্টের প্রকৃতি :

গুলেন মুভমেন্টকে বলা যেতে পারে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লাখ লাখ মানুষের সামষ্টিক প্রচেষ্টা হিসেবে। আর এর সাথে জড়িত রয়েছে হাজার হাজার ফাউন্ডেশন, কোম্পানি, পেশাজীবী সংগঠন, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ। আর এসব সংগঠনের মধ্যে গাঁথুনি হিসেবে কাজ করে তাদের মূল্যবোধ ও আদর্শ। এসব সংগঠন একে অপরকে সহযোগিতা করে তাদের কর্মদক্ষতা অর্জনের জন্য। উদাহরণস্বরূপ কোনো শহরের কোনো ফাউন্ডেশন অন্য কোনো শহর বা নগরে ভিজিট করে তাদের অদক্ষতা দূর করে দক্ষতা অর্জনের জন্য।
উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়ে গুলেনের ও গুলেন মুভমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গী : কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফেতুল্লাহ গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টের অংশীদের দৃষ্টিভঙ্গী :
(১) রাষ্ট্র (State) : গুলেন আন্দোলনের অংশীরা রাষ্ট্রকে সামাজিক শৃঙ্খলা, মানবাধিকার, ব্যক্তিক অধিকার, ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জামিনদার হিসেবে বিবেচনা করে। রাষ্ট্র সম্পকির্ত ভাবনায় নুরসীর সাথে গুলেনের মিল পাওয়া যায়। গুলেন বলেন, অনেক মুসলিম দেশ অপেক্ষা আমেরিকা ও ইউরোপে ইসলাম ভালোভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই স্বাধীনতা ও আইনের শাসন ‘ব্যক্তিক ইসলাম’ এর জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও ইসলামের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার অস্তিত্ব জরুরি নয়; বরং শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কমিউনিটিই ইসলামের বিকাশের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যা হোক, রাষ্ট্র নয় গণতান্ত্রিক সিস্টেমের অধীনে কমিউনিটিই অধিক প্রয়োজন। বর্তমানে গুলেন ইসলামিক রাষ্ট্র নয় বরং উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিই জানান।
(২) গণতন্ত্র (Democracy) : বিভিন্ন আলোচনায় গুলেন পুনর্ব্যক্ত করেন, গণতন্ত্র হতে পশ্চাদপসরণের কোনো সুযোগ নেই। ২০০৫ সালে মেহমেত গানডেমের সাথে এক সাক্ষাতকারে গুলেন বলেন, “একজন অবিশ্বাসীকে যেমন কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই বাস করতে দেয়া উচিত তেমনি একজন বিশ্বাসীকেও পরিপূর্ণভাবে তার ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগ দেয়া উচিত।’’ তিনি আরো বলেন, “মানব উদ্ভাবিত শাসনপদ্ধতির মধ্যে গণতন্ত্রই সর্বোত্তম”।
গণতন্ত্র ক্রমাগত তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠবে এবং তুরস্কসহ যে সকল দেশে গণতন্ত্র ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি সে সকল দেশে তা প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও উন্নয়ন, বাক স্বাধীনতা ও মানবকল্যাণের জন্য অপরিহার্য।
(৩) সেক্যুলারিজম (Secularism) : গুলেন ও তার আন্দোলনের অংশীদো নিকট আমেরিকার ন্যায় সেকিউলার টাইপ রাষ্ট্রের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আমেরিকা ও ইউরোপে যারা বসবাস করছে তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব সমাজে বা কমিউনিটিতে অবদান রাখছে এবং মানব-সমাজের সৌন্দর্য বর্ধন করছে।
(৪) তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ : গুলেন মুভমেন্টের অংশীরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণের পক্ষে। তাদের মতে, এতে রাজনৈতিক শোষণ বন্ধ হয়ে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। আর অধিক গণতন্ত্রায়নের ফলে স্বচ্ছতা বাড়বে, দুর্নীতি কমবে, সুস্থ অর্থনৈতিক প্রতিযোফগতা এবং জীবনমান বৃদ্ধি পাবে।
(৫) মহিলাদের ভূমিকা (Women’s Role) : গুলেন বলেন, তুরস্কের অধিকাংশ মুসলিম হানাফী মাজহাবের অনুসারি এবং এই মতাদর্শ অনুসারে মহিলারা সমাজের যে কোনো পদ অলঙ্কৃত করতে পারে। এমন কোনো পেশা নেই যা মহিলারা অলঙ্কৃত করতে পারে না। তদুপুরি, কিছু পদ আছে যা নারীদের জন্য আদর্শ নয়- যেমন যুদ্ধ। গুলেন মুভমেন্টের সাথে যুক্ত নারীরা সকল কাজে অংশগ্রহণ করে। যেমন স্কুল শিক্ষক, প্রশাসক, কলাম লেখক, মিডিয়ার প্রযোজক , পরিচালক, হাসপাতালের ডাক্তার ইত্যাদি।
(৬) কুর্দি ইস্যু : কুর্দি ইস্যুতে গুলেনের বা গুলেন মুভমেন্ট অংশীদের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর মাধ্যমে :
-কুর্দি জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হওয়া দরকার;
– কুর্দি ও তুর্কিদের সাধারণ সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর উপর জোর দেয়া দরকার;
– কুর্দিদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দরকার;
– কূটনীতি ও শক্তি প্রয়োগের মাঝে সাম্য থাকা দরকার।
(৭) আলভি ইস্যু : গুলেন রাজনৈতিক কারণে আলভিদের ওপর চালানো অত্যাচার বন্ধের দাবি করেন। গুলেন আলভিদের প্রচলিত ঐতিহ্যের প্রতি তুর্কি শাসকদের সম্মান প্রদর্শনকে উৎসাহিত করেন।
(৮) ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ : তুরস্ক এবং  এর বাইরে গুলেন একজন আন্তঃধর্মীর সংলাপের ক্ষেত্রে এক অগ্রপথিকের মর্যাদায় আসীন হয়েছেন। ৯/১১ (নাইন ইলেভেনের) কয়েক বছর পূর্বে, নব্বই দশকের প্রাথমিক দিকে গুলেন আন্তঃবিশ্বাস সংলাপকে উৎসাহিত করেন এবং তিনি মত প্রকাশ করেন যে, “ধর্ম কোনো সংঘাতের কারণ নয় এবং ধর্মকে সংঘাতের কোনো কারণ হতে দেয়াও উচিত নয়।” তিনি গ্রিক অর্থোডক্স, আমেরিকান অর্থোডক্স, ইহুদি এবং অন্যান্য বিশ্বাসী কমিউনিটির সাথে সংলাপ করেন। গুলেনের এই সংলাপের ফলে বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীদের মাঝে বিরাজমান সম্পর্ক ‘শত্রুতা থেকে সহযোগিতায়’ পরিণত হয়। তুরস্ক সরকার এই অবস্থায় আন্তঃবিশ্বাস সংলাপের জন্য একটি অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করে যা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত। এ সকল উদ্যোগের ফলে প্রধানমন্ত্রীর অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাদেশিক সরকার এসব আন্তঃবিশ্বাস সংলাপে অংশগ্রহণ করে। এ সকল উদ্যোগের কারণে জনগণ গুলেনের গুনমুগ্ধে পরিণত হয়। আর এই সকল বড় বড় উদ্যোগ এমনিতেই হয়নি। এসব কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে অনেক বাধা-বিপত্তিও ডিঙাতে হযেছে তাকে। চরমপন্থী মুসলিম গ্রুপের নিকট তিনি চরমভাবে সমালোচিত হন। তারা গুলেনকে গোপন খ্রিস্টান কিংবা রোমের গোপন কার্ডিনাল বলতেও দ্বিধা করেননি।
(৯) অসহিংসতা : সেই ১৯৭০ সাল থেকেই সহিংসতার বিরুদ্ধে গুলেনের দৃঢ় অবস্থান একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। তুরস্কে রাজনৈতিক নৈরাজ্যের সময়ও গুলেন ক্রমাগত সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হিংসাত্মক কার্যক্রমের বিরোধিতা করেন এবং তাঁর অনুসারীদের কোনো ধরনের সহিংসতায় যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করেন। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে তিনি ইসরাইলের সাধারণ জনগণের উপর সাদ্দামের রকেট হামলার নিন্দা করেনÑ মসজিদের হাজার হাজার মুসলিমের সামনেই নাইন-ইলেভেনের পর তিনি এই হামলার নিন্দা করেন এবং বিন লাদেনকে তার চার পাশের লোকসহ দানব বলে আখ্যায়িত করেন। মানবতাবাদী এবং ধর্মীয় উভয় প্রেক্ষিতেই তিনি বিন লাদেনের কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা করেন।
(১০) বিজ্ঞান ও কলা : গুলেন তাঁর অনেক লেখার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও কলা উভয়কেই প্রমোট করেন। মানব সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞান অপরিহার্য। তাই তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। মানব মনের উৎকর্ষ সাধনে শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় এনে তিনি সাংস্তৃতি চর্চার উপর জোর দেন।
(১১) জাতীয়তাবাদী (Nationalism) : দেশপ্রেম; সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি নয়। অন্তর্ভুক্তিকরণ (Inclusive), পজেটিভ এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের তিনি পক্ষপাতি। গুলেন মুভমেন্টের সাথে কুর্দি অংশীও রয়েছে। মূলত তিনি আনাতোলিয়ার সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত তার্কিস জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
গুলেন পরিচিতি :

ফেতুল্লাহ গুলেন হলেন বর্তমান তুরস্কে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী। গুলেন ১৯৪১ সালে পূর্ব তুরস্কের আরজুরাম-এ জন্মগ্রহণ করেন। ফেতুল্লাহ গুলেন তার বাল্যকাল কাটান ট্রাডিশনাল সুফি পরিবেশে। তিনি বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের নিকট শিক্ষালাভ করেন। তিনি প্রথমে ধর্মবিজ্ঞানে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে তিনি আধুনিক সামাজিক ও ভৌত বিজ্ঞানের বিষয়েও পড়াশুনা করেন। শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহই গুলেনকে তার সমকক্ষদের  ছাড়িয়ে যেতে সহযোগিতা করে। ১৯৫৮ সালে পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেন। এর পুরস্কারস্বরূপ তাকে ধর্মপ্রচারকের সরকারি লাইসেন্স প্রদান করা হয় এবং ইজমির শহরে ধর্ম-প্রচারের জন্য পদায়ন করা হয়। ইজমির তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম প্রদেশ। ইজমিরেই গুলেন তার কনসেপ্ট বিল্ড আপ এর কাজ শুরু করেন এবং তাঁর শ্রোতার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকেন। তাঁর বক্তব্য ও বাক্যে তিনি তৎকালীন সময়ের আবশ্যকীয় সামাজিক সমস্যার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল তরুণ সমাজকে আহ্বান জানানো। যাতে তারা মানবতাবাদ, মানবাধিকার ও জ্ঞান ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকায়নের কাজ করে।
গুলেন কেবলমাত্র শহরের মধ্যেই তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ রাখলেন না। তিনি পুরো আনাতোলিয়া প্রদেশ জুড়ে ভ্রমণ করলেন এবং শুধু মসজিদেই নয় বরং শহরের বিভিন্ন অডিটোরিয়াম, কনফারেন্স হল এবং ক্যাফে কর্নার, চা-কর্নার প্রভৃতি জায়গাতেও বক্তব্য রাখলেন। তাঁর এই সর্বত্র গমন তাকে সমাজের সকল প্রতিনিধিদের নিকট পৌঁছানোর সুযোগ এনে দেয়। দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতিগত কারণে তিনি, বিশেষভাবে, ছাত্র সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেন। তাঁর বক্তব্যের বিষয় আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক; সব সময় ছিল বৈচিত্র্যময়। কখনো তা শুধুমাত্র রাইচুয়ালিস্টিক ধমের্র মাঝে সীমিত ছিল না। তিনি বক্তব্য দিতেন শিক্ষা, বিজ্ঞান, ডারউইনবাদ, অর্থনীতি ও সামাজিক সুবিচারের ওপর। বিভিন্ন বিষয়ে তার চিন্তার গভীরতা ও মান বিভিন্ন স্তরের লোকজনদের মনে গভীরাকারে রেখাপাত  করে এবং তিনি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ ও সম্মান অর্জন করেন। গুলেন তাঁর আনুষ্ঠানিক ধর্ম প্রচারণার কাজ হতে ১৯৮১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তিনি ১৯৬০ সাল হতেই শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ শুরু করেন এবং শিক্ষা সংস্কার নিয়ে তার ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা তাকে তুরস্কে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। ১৯৯৯ সালে তিনি তুরস্ক সামরিক সরকারের মিথ্যা অভিযোগের প্রেক্ষিতে দেশত্যাগ করে আমেরিকা গমন করেন এবং সেই সময় থেকে অদ্যাবধি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়ায় অবস্থান করছেন।
গুলেন ও গুলেন মুভমেন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কয়েকটি তথ্যসূত্র :

১. The Gulen Movment : A Sociological Analysis of a civic movment Rooted in Moderate Islam.
– by Helen Rose Ebaugh. (soft copy available
২. The vision & Impact of Gulen Movment A new Paradiam of Social Activism.
– by Maimul Ahsan Khan (pr. of law Dept. DU).Only hard copy available to the writer at DU.
৩. Introducing Fethullah Gulen in Bengal and Beyond -by Maimul Ahsan Khan (Only hard copy available to the writer at DU)
৪. International conference on Gulen Movement (2007) (onlySoft copy available)
৫. Official Website of Fetullah Gulen (http://www.gulenmovement.us/ and http://gulenmovement.com/)
বাংলাদেশে গুলেন প্রভাবিত স্কুল (ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত) :

1. International Turkish Hope School, Dhaka.
2. Uttara pre-school & Junior Section.
3. Gulshan pre-school Section
4. Gulshan Junior Section
5. Uttara Senior Section (Boys)
6. Uttara GCE Section (Boys)
7. Uttara Senior Section (Girls)
8. Chittagong Branch
9. Bogra pre-school & Education Centre.
বাংলাদেশে গুলেন মুভমেন্ট :

বিগত ৪০ বছরে এন্টার্কটিকা ব্যতীত  সকল মহাদেশে গুলেন মুভমেন্ট তার কার্যক্রম বিস্তৃত করলেও  এবং বাংলাদেশের সমাজসেবী কিংবা ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক আন্দোলনে গুলেন পরিচিত হলেও এ নিয়ে বিস্তৃত একাডেমিক, ডিসকোর্স  হয়নি বললেই চলে। তবে উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর মাইমুল আহসান খানের (email id:khanmaimul@yahoo.com) সাথে গুলেন মুভমেন্টের পরিচয় ঘটে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে গুলেন মুভমেন্ট এর উপর লিখিত তাঁর অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং গুলেন মুভমেন্ট বিষয়ে দুইটি বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই তিনিই বর্তমান বাংলাদেশে এই মুভমেন্টের ওপর একমাত্র একাডেমিক রিসোর্স। তাছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র যারা ইসলামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা অনেকেই এই গুলেন মুভমেন্ট এর সাথে পরিচিত। নিজস্ব পেরিফেরিতে এরা স্টাডি সার্কেল বা আলোচনার মাধ্যমে এই আন্দোলনের মূল নির্যাস জানার চেষ্টা করছেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় ও ভৌগোলিক বিবেচনায় কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে ডিসকাশন বা পর্যবেক্ষন পর্যায়ে রয়েছেন।
সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসী ও ফেতুল্লাহ গুলেন :

তুরস্কে ইসলাম প্রচার ও ইসলাম-ভিত্তিক সংগঠনে সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসী একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব (১৮৭৪-১৯৬০)।
তুরস্কের রাজনীতিতে ‘ইসলামী রাষ্ট্রের ইসলামী শরিয়াহর’ পরিবর্তে ‘ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ধর্ম পালনে গতিশীলতা ও নিশ্চিতকারী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ দাবি ছিল  নুরসীর। আর এই দাবির মাধ্যমে নুরসী তুরস্কের রাজনীতিতে ইসলামপন্থী আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতেন। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ১৯২৫ সালে রাজনৈতিক চরমপন্থা পরিহার করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি কুর্দী নেতাদের আহ্বান জানান। তৎকালীন ইসলাম-ভিত্তিক সংগঠনের নেতাদের সাথে কিছু মিল-সাদৃশ্যের পাশাপাশি কিছু বিষয়ে নুরসীর ভিন্নমতও ছিল। যেমন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নার সাথে নুরসী একটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন। সেটি হলো ইহুদি বা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদকে নুরসী কখনো শত্রু মনে করতেন না। বরং বস্তুবাদী দর্শন এবং সমাজতন্ত্রের কিছু মূলনীতিকে তিনি শুধু মুসলিম নয় পুরো মানবতার শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। গোটা তুরস্ক জুড়ে ছিল নুরসীর লাখ লাখ অনুসারী এবং তাদের এই আন্দোলন নূর (আলো) মুভমেন্ট নামে পরিচিত। ফেতুল্লাহ গুলেনও ছিলেন নূর মুভমেন্টের একজন অনুসারী। ১৯৬০ সালে নুরসীর মৃত্যুর পর নুরসীর অনুসারীরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। নূরসীর প্রচারিত মূলনীতি ও শিক্ষা নিয়ে ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে গুলেন তার কাজ/দাওয়াত শুরু করেন। তবে নুরসী মুভমেন্টের অনুসারী হলেও গুলেন তার চিন্তা ও কর্মে এক নতুন ডাইমেনশন যুক্ত করেন শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে ‘গোল্ডেন জেনারেশন’ তৈরির পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবনের মাধ্যমে।
মন্তব্য:

বলা হয়, মিসর, তার্কি, ফিলিস্তিন, লেবানন, তিউনিসিয়া, জর্দান, মরক্কোসহ মধ্য এশিয়ার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর যে অগ্রগতি তার মূলে রয়েছে এসব দেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর ডাইমেনশনগত পরিবর্তন। এসব দেশে ইসলামভিত্তিক আন্দোলনগুলো তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সামাজিক মঞ্চে। সমাজসেবার মাধ্যমে সমাজের মানুষের নৈতিক পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তনের মাধ্যমে  রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে। ব্যক্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজ হতে রাষ্ট্র পরিবর্তনের কৌশল যে রাষ্ট্র হতে সমাজ, সমাজ হতে ব্যক্তি পরিবর্তনের কৌশল অপেক্ষা শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ তা ইতোমধ্যে সেসব দেশে প্রমাণিত হয়েছে।
একে (তার্কি) পার্টির ক্ষমতায়ন কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের  আরব স্পিং এবং পরবর্তী যে সিকোয়েন্স তার পেছনে রয়েছে সমাজ সেবামূলক কার্যাবলীর মাধ্যমে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটানোর প্রচেষ্টা। আর এ সকল সমাজ সেবামূলক কার্যাবলীর পেছনে মূল যে দর্শন তার পেছনে রয়েছে ফেতুল্লাহ গুলেন এবং গুলেন মুভমেন্ট এর প্রভাব।
বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বাস। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আংশিক বিজয় শুরুর পর হতে ধীরে ধীরে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার এই অংশে সুফী সাধক, পীর, ওলী-আউলিয়াদের মাধ্যমে ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটেছে। পরবর্তীতে ঔপনিবেশবাদের সূচনা এবং তার সমাপ্তিতে উত্থান ঘটেছে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার। এই পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে চলার  ফলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আলেম ও ওলামার মাঝে নানারূপ চিন্তা-চেতনার বিকাশ লাভ করেছে। ফলে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ভিত্তিক চিন্তার ক্ষেত্রে ইসলামের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা অনুধাবন করতে মতপার্থক্যের উদ্ভব হয়েছে। আর এর সুস্পষ্ট লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় বিংশ শতাব্দীতে মাওলানা মওদূদীর ‘ইসলামী আন্দোলন’ এবং মাওলানা ইলিয়াস শাহের ‘তাবলীগ জামাত’ ও ভারতের দেওবন্দ মাদরাসার কওমী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা পদ্ধতির’ কৌশল এর মধ্যে।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দল জামায়াত সবচেয়ে প্রভাবশালী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইসলাম বিষয়ক মূলনীতি বাস্তবায়নের কোনো ম্যানিফেস্টো না থাকলেও ইসলাম বিরোধী আইন প্রণয়নের নমুনা তেমন ছিল না। কিন্তু বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের ভু-রাজনৈতিক কৌশল, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের উত্থান, চীনের বিপরীতে ভারতকে আমেরিকার একপাক্ষিক নিঃশর্ত সমর্থনদান, গোলাকায়নের প্রভাব, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমুহের বিশ্বব্যাপী অবাধ চলাচল, বাংলাদেশে বামপন্থী দল ও ব্যক্তিদের আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্তি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ক্রমাগত হস্তক্ষেপ এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে। ফলে ক্রমশ প্রতিহিংসার রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। রাষ্ট্র ও মানবসেবার ঊর্ধ্বে স্থান পাচ্ছে কূটচাল, ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ। আর দলগুলোর মাঝের এই বিভাজন থেকেই জঙ্গিবাদী কিংবা ফ্যাসিবাদী চিন্তার সূত্রপাতের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।
এমনি প্রেক্ষাপটে, ইসলামপন্থী ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, আলেম ও রাজনীতিবিদদের মাঝে বিভাজনের সমাধান হিসেবে ভাবা হচ্ছে গুলেন মুভমেন্টের চিন্তাধারাকে। আর এই চিন্তার প্রথমেই যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে ‘রাজনীতি বিষয়ে গুলেনের ও মাওলানা মওদূদীর চিন্তার পার্থক্যে’।
মাওলানা মওদূদীর মতে জাতি রাষ্ট্রভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায়নই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের একমাত্র মাধ্যম। চাই তা গণতন্ত্রের মাধ্যমে হোক অথবা ইরানের মতো বিপ্লবের মাধ্যমে হোক। অপরদিকে ফেতুল্লাহ গুলেন জাতি-রাষ্ট্রভিত্তিক ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা’র কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র বলতে মাওলানা মওদূদী যে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রকে বুঝান তা মানতে চান না। তিনি ধর্ম তথা ইসলামকে রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেক ঊর্ধ্বে  বলে মনে করেন। গুলেনের মতে, ইসলামের উদ্দেশ্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয় বরং মানুষের মনকে আলোকিত করার মাধ্যমে সুবিচারপূর্ণ এক মানব  সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। তাই জামায়াত যে ‘ইসলামী রাষ্ট্র; রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং রাজনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে গুলেনের নিকট এসব কনসেপ্ট অনেকটা গুরুত্বহীন কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, আলোকিত মানুষ গঠন, সামাজিক সুবিচার, মানবতাবোধ, মৌলিক মানবাধিকার, আপন-আপন  ধর্মের অনুশাসন পালনের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে এক শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলাই ইসলামের মুখ্য উদ্দেশ্য।
এমনি প্রেক্ষাপটে, দর্শন বা মতবাদগত মতপার্থক্য এড়িয়ে সামনে চলার পথ বের করাই এখন মুখ্য বিষয়। এজন্য প্রয়োজন ইসলামের গভীর উপলব্ধি। তাছাড়া জামায়াত তার রাজনৈতিক দর্শনগত অবস্থান পরিবর্তন না করে গুলেন মুভমেন্টের অন্যান্য কার্যাবলী থেকে কিভাবে উপকৃত হতে পারে তা আমাদের ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ফেতুল্লাহ গুলেনের জীবন ও কর্মের ও তার ‘হিজমেত’ মুভমেন্টের এক মৌলিক অধ্যয়ন। প্রয়োজন ‘হিজমেত’ মুভমেন্ট কিভাবে মুসলিম সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, মানুষত্ববোধ, ইসলামী মূল্যবোধের বিকাশে পাশ্চাত্য কালচারাল আগ্রাসনের মোকাবেলা করছে তার গভীর পর্যবেক্ষণ। মুসলিম দেশসহ বিশ্বব্যাপী ইসলামের অর্পিত দায়িত্ব পালনে কিভাবে ভূমিকা রাখছে তার মৌলিক গবেষণা। তাহলেই ইসলামের মৌলিক নীতিমালা বাস্তবায়নে গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টের ভূমিকা স্পষ্ট হবে। গুলেন ও গুলেন মুভমেন্টের আলোকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ও সামাজিক দল বা গ্রুপগুলো তাদের কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে পারবে। পারবে এ দেশের হতদরিদ্র মানবগোষ্ঠীকে দুর্নীতিপরায়ণ শোষক, প্রতারক, শাসক গোষ্ঠীর হাত হতে উদ্ধার করতে। পারবে সুবিচারপূর্ণ এক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে। আর সেদিনই পূরণ হবে মানুষ ও মানবতার স্বপ্ন। বাস্তবায়ন ঘটবে এক আদর্শ জীবনব্যবস্থা, বিজয়ী হবে ইসলামের সুমহান বাণীর।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নফস, রুহ, কলব......পরিচয়, ব্যাধি, প্রতিকার

চৌদ্দশ বছরের আমরা এক কাফেলা

হাদিস ছাড়া শুধু কুরআন অনুসরণ কতটুকু যৌক্তিক