ইসলামে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা


এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান 
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” [সূরা বনি ইসরাইল : ৭০] 

পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্টজীবের মধ্যে মানুষই সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। এমনকি নিষ্পাপ ফেরেশতাদের তুলনায়ও মানুষের মর্যাদা বেশি। মানুষ আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম সৃষ্টি, আল্লাহর প্রতিনিধি, সৃজনশীল, বুদ্ধিসম্পন্ন, দায়িত্বশীল এবং মহাগ্রন্থ আলকুআনের ধারক-বাহক ও অনুসারী। জগতের যাবতীয় সৃষ্টিজীব মূলত মানুষের সেবায় নিয়োজিত। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। আল্লাহ মানুষের আকার-অবয়ব অসাধারণ সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।” [সূরা আদ্বদোহা : ৪]
মানুষকে আল্লাহ নিজের প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে অভিহিত করেছেন। মানুষকে কেন্দ্র করেই বিশ্বলোক সৃষ্টি। সৃষ্টিকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষই বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন প্রাণী। এছাড়া বাকশক্তি দিয়ে মানুষকে সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। চারিত্রিক গুণাবলির দিক থেকে মানুষ ফেরেশতার চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন করা হয়েছে। সৃজনশীলতা মানুষের মর্যাদার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আল্লাহ মানুষকে এমন ক্ষমতা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন যে, তার আত্মরক্ষা, আত্মোন্নতি বিধানের জন্য সে সব সময় আবিষ্কার ও সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত। প্রাণীর মধ্যে মানুষ একমাত্র দায়িত্বশীল। কারণ তারাই একমাত্র সমাজে বসবাস করে। সামাজিক সহমর্মিতা ও সম্প্রীতি শুধু মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, পার্থিব কৃতকর্মের জন্য মানুষের জন্য নির্ধারিত আছে জান্নাত ও জাহান্নাম। ভালো কাজ করলে রয়েছে জান্নাত আর মন্দ কাজ করলে জাহান্নাম। বুদ্ধি ও চেতনায় মানুষকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দান করা হয়েছে। এর সাহায্যে সে সমগ্র ঊর্ধ্বজগৎ ও অধঃজগৎকে নিজের কাজে নিয়োজিত করতে পারে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “এবং তিনি তোমাদের জন্য অধীন ও আজ্ঞাবহ করেছেন আসমান ও জমিনের সব কিছু।” এ শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিয়ে মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের ভাষায়, “এবং যখন আমি আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলিস ব্যতীত সকলে সিজদা করল। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।” [সূরা বাকারা : ৩৪] এমনকি মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা বিবেচনা করেই তার জান, মাল, বিবেক-সম্ভ্রম, ধর্ম ও বংশ রক্ষা করার জন্য ইসলাম বহু বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে। মানুষের ধর্ম রক্ষার জন্য জিহাদের নির্দেশনা; তার জান ও রক্তকে হিফাজত করার জন্য কিসাসের বিধান জারি করেছে। মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য গিবত-শেকায়েত ও পরনিন্দার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মানুষের বংশপরম্পরাকে রক্ষা করার জন্য জিনা-ব্যভিচারের পথ রুদ্ধ করে বৈবাহিক জীবনাচারের নির্দেশ প্রদান করেছে। মানুষের মেধা-মনন, বিবেক-বুদ্ধি সতেজ ও পরিশোধিত রাখতে সব মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করেছে। মানুষের সম্পদকে রক্ষা করার জন্য সব রকমের চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ও প্রতারণার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। মর্যাদার দিক থেকে ইসলাম মানুষকে যেমন সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করেছে তেমনি দায়িত্ব-কর্তব্যের বিচারেও মানুষের অবস্থানকে রেখেছে শীর্ষে। সেরা জীব হিসেবে মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাব কষে কষে ফেলতে হয়। ইচ্ছে করলেই মানুষ যা খুশি তা করতে পারে না। মানুষের আছে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় বাধা নিষেধ। ইচ্ছা ও কর্মে স্বাধীন হলেও মানুষের দায়বদ্ধতা প্রচুর। মানুষকে নিজের সম্মান ও মর্যাদা সংরক্ষণে যেমন সচেতন হতে হবে ঠিক তেমনি অন্যের সম্মানহানী হয় এমন কাজ থেকে সর্বদা বিরত থাকতে হবে । 
ইসলামে মানুষের ব্যক্তিগত সুনাম ও সম্মান নষ্ট করা তো দূরের কথা বরং তা রক্ষা করার জন্য নিকট ও দূর আত্মীয়সহ সকলের সাথে সদয় আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদাচরণ করবে। আল্লাহ দাম্ভিক ও আত্মগর্বীকে পছন্দ করেন না।’’ [সূরা নিসা : ৩৬]
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষকে খারাপ নামে ডাকা অথবা কাউকে বিদ্রুপাত্মকভাবে ডাকা উচিত নয়; বরং এর পরিবর্তে সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সুনাম, মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার জন্য যথাযথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে বিদ্রুপ না করে। কেননা তারা তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেন বিদ্রুপ না করে, কেননা তারা তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কর না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পরে মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ পরিত্যাগ করে না তারাই অত্যাচারী।’’ [সূরা হুজুরাত : ১১]
ইসলামে মানুষের সুনাম ও সম্মান রক্ষার জন্য অত্যন্ত সতর্কতামূলক বাণী উচ্চারণ করেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না এবং তোমাদের কেউ যেন অন্যের গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে ভালবাসো? বস্তুতঃ তোমরা এটাকে ঘৃণাই কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু।’’ [সূরা হুজুরাত : ১২]
একে অপরের গৃহে প্রবেশ করার বিধান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অপরের গৃহ সমূহে প্রবেশ কর না, যে পর্যন্ত না তাদের অনুমতি গ্রহণ কর এবং তার বাসিন্দাদেরকে সালাম প্রদান কর। এই পন্থাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।’’ [সূরা নূর : ২৭]
আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের কোন ভাই যাতে করে অন্য মুসলিম ভাইকে ছোট না করে অর্থাৎ তার মান ও সম্মান ক্ষুন্ন না করে। কেননা প্রত্যেক মুসলিম এর প্রতি অন্য ভাই এর রক্ত, মাল ও সম্মানকে ক্ষুন্ন করা হারাম করা হয়েছে। (রক্ত দ্বারা উদ্দেশ্য হত্যা করা।” [সহীহ মুসলিম-৪/১৯৮৬, হাদীস-২৫৬৪]
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমান কর্তৃক অন্যের সুনাম, মর্যাদাকে নষ্ট করা তো দূরের কথা; বরং সর্বদা সে আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে যে, কখনও সে অন্যকে কষ্ট দিচ্ছে কি-না। যেমন ইকরামা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহাকে বলতে শুনেছি, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাত তুলে দু‘আ করতে দেখেছেন। তিনি এই দু‘আ করছিলেন, “হে আল্লাহ! আমি মানুষ, মানুষসুলভ দুর্বলতাবশতঃ আমি যদি তোমার কোন মুমিন বান্দাকে যদি কোনভাবে আঘাত দিয়ে থাকি বা কোনরূপ কষ্ট দিয়ে থাকি তবে এজন্য আমাকে শাস্তি দিও না।’’ [আহমাদ, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৬১০]
ইসলামে যেকোন ব্যক্তির সম্মান ও সুনাম রক্ষা করা একটা পবিত্র বিষয় যা অলংঘনীয়। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন, “তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সম্মান তোমাদের জন্য ঠিক তেমনি পবিত্র, যেমন তোমাদের আজকের এই দিন এই মাস এই শহর পবিত্র।’’ [ইবনে মাজাহ, হা/৩০৫৫]
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা অবশ্যই ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত হয়ো না এবং (বেচা-কেনায়) একে অপরেরকে ধোঁকা দিয়ো না। পরস্পরে হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ভাব রেখো না, একজন থেকে আর একজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না। বরং সবাই এক আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই ভাই হয়ে যাও।’’ [বুখারী হা/৬০৬৬]
আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘আমি কি তোমাদেরকে সিয়াম, সালাত ও সদকার মর্তবা থেকেও শ্রেষ্ঠ বিষয় সম্পর্কে বলব না?’ সবাই আরজ করলেন, ‘আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন।’ তিনি বললেন, ‘বিবাদরতদের মাঝে শান্তি স্থাপন করা। আর জেনে রেখো, পরস্পর কলহ-বিবাদই তো মানুষকে মুড়িয়ে দেয়।’’ [মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৭৫০৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৯১৯; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৫০৯)]
উবাদাহ বিন সামিত রাদিআল্লাহু আনহু ও আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তুমি কারোর কোনো ধরনের ক্ষতি করো না। তেমনিভাবে তোমরা পরস্পর একে অপরের ক্ষতি করার প্রতিযোগিতা করো না।’’ [ইবন মাযাহ : ২৩৬৯, ২৩৭০]
আবু সিরমাহ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করতে চায়, আল্লাহ তা‘আলা তার ক্ষতি করেন। তেমনি ভাবে যে ব্যক্তি অন্যের উপর কঠিন হয় আল্লাহ তা‘আলাও তার উপর কঠিন হন।’’ [ইবন মাযাহ : ২৩৭১]
মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন, “ দ্বীন-এর ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বেরও করে দেয় নি তাদের সাথে সদাচার ও সুবিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেননি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালবাসেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা দ্বীন-এর ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধু করে তারাই সীমালংঘনকারী।” [সূরা মুমতাহিনা : ৯]
ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়ায রাদিআল্লাহু আনহুকে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় বলেন, মাজলুমের বদ-দু‘আকে ভয় কর, কেননা তার বদ-দু‘আ ও আল্লাহর মাঝখানে কোন বাধা নেই।” [তিরমিযী : ১৯৬৩] 
মানবতার লালন ও সংরক্ষণের প্রতি ইসলামের এতই সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি যে যুদ্ধাবস্থায়ও সে মানবাধিকারের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ রাখার শিক্ষা দেয়। প্রথম খলিফা আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু যখন সিরিয়ায় সেনা পাঠান তখন তাদের ১০টি নির্দেশ দিয়ে দেন। সে নির্দেশ ছিল এই : ১. নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কেউ যেন হত্যা না করে, ২. লাশ যেন বিকৃত করা না হয়, ৩. আশ্রম, প্যাগোডা ও কুঠরিতে উপাসনারত সন্ন্যাসী ও তপস্বীদের কষ্ট দেয়া যাবে না। কোনো উপাসনালয় ভাঙা যাবে না, ৪. ফলবান বৃক্ষ যেন কেউ না কাটে এবং ফসলের ক্ষেত যেন পোড়ানো না হয়, ৫. জনবসতিগুলোকে (সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে) যেন জনশূন্য না করা হয়, ৬. পশুদের যেন হত্যা করা না হয়, ৭. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা চলবে না, ৮. যারা আনুগত্য স্বীকার করবে তাদের জানমালকে মুসলমানদের জানমালের মতো নিরাপত্তা দিতে হবে, ৯. গণিমতের সম্পত্তি যেন আত্মসাৎ করা না হয় ও ১০. যুদ্ধে যেন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা না হয় [মুসান্নাকে ইবনে আবি শায়বাহ : ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪৮৭-৪৮৮]
ইসলামী রাষ্ট্রে শাসকের জন্য কারো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা কতটুকু এবং এই ক্ষেত্রে নাগরিকের অধিকার কতটুকু ওমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুর একটি ঘটনা থেকে তা সহজে অনুমান করা যায়। আব্দুর রহমান ইবনু আওফ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, একদা তিনি ওমর রাদিআল্লাহু আনহুর সাথে মদীনার প্রজা সাধারণের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য বের হলেন। হাটতে হাটতে হঠাৎ একটি বাড়ির মধ্যে প্রদীপ তাদের দৃষ্টিগোচর হল। অতঃপর তারা সেদিকে যেতে লাগলেন। তারা বাড়ির নিকটবর্তী হয়ে দেখলেন দরজা আটকানো একটি ঘরের মধ্যে একদল লোক রয়েছে এবং সেখানে উচ্চস্বরে আওয়াজ হচ্ছে। তখন ওমর রাদিআল্লাহু আনহু আব্দুর রহমানের হাত ধরে বললেন, তুমি কি জান এ বাড়ীটি কার? তিনি বললেন, না। ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, এ বাড়ীটি রাবী‘আহ বিন উমাইয়া ইবনে খালাফের। হয়তো তারা মদ পান করছে, তুমি কি মনে কর? আব্দুর রহমান বললেন, আমি মনে করি, আমরা আল্লাহর নিষেধকৃত পন্থায় এখানে এসেছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নিষেধ করে বলছেন, ‘তোমরা গোয়েন্দাগিরি কর না” [সূরা হুজুরাত : ১২] অথচ আমরা গোয়েন্দাগিরি করছি। একথা শুনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু তাদের ছেড়ে ফিরে আসলেন।” [মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক, হা/১৮৯৪৩; হাকেম হা/৮১৩৬]
মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাতকে সমর্থন করা হয় না। হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, প্রতিশোধ গ্রহণের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে তারা মানবতাবর্জিত ও সভ্যতার শত্রু। শান্তি, সাম্য ও মানবিক ধর্ম ইসলাম মানুষের জানমাল রক্ষা করার জন্য সব ধরনের জুলুম, অন্যায় ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম নিরপরাধ মানুষ হত্যা করাকে শিরকের পর বড় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কবিরা গোনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গোনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।” [বুখারি : ৬৮৭১, মুসলিম : ৮৮]
নিরীহ মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চেয়ে ভয়াবহ পাপ আর সমাজে নেই। ইসলামী শরীয়তে পৃথিবীর সব মানুষ মিলে যদি একটি অন্যায় হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তবে কিয়ামতের দিন সবাইকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যদি আসমান ও জমিনের সব অধিবাসী একজন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যার জন্য একমত হয়, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” [মুসনাদে আহমদ] চূড়ান্ত বিচারের দিনে অন্যায় হত্যাকাণ্ডের মোকদ্দমা দিয়েই বিচারকার্য শুরু হবে। “কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে তা হলো, রক্তপাত বা হত্যা সম্পর্কিত।” [বুখারি : ৬৩৫৭]
নিরপরাধ মানুষ হত্যাকারীকে দুনিয়াতেও মৃত্যুদণ্ড বা অর্থদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা সেই জীবনকে হত্যা কোরো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন- সংগত কারণ ছাড়া। যে অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি অবশ্যই তার অভিভাবককে (মৃত্যুদণ্ড, অর্থদণ্ড বা ক্ষমার) অধিকার ও ক্ষমতা দান করেছি। সুতরাং এ ব্যাপারে সে যেন সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয়ই সে হবে সাহায্যপ্রাপ্ত।” [সূরা বনি ইসরাইল : ৩৩] দুনিয়ার শাস্তি ভোগ করার পরও পরকালে অন্যায় হত্যাকারীর জন্য রয়েছে ভীষণ শাস্তি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে, সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা।...আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [সূরা আন-নিসা : ৯২-৯৩]
বরং এমন অত্যাচারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন দ্বিগুণ শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “(রহমানের বান্দা তারাই) যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাস্যের ইবাদাত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। যারা এ কাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কিয়ামাতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।” [সূরা আল-ফুরকান : ৬৮-৬৯]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হত্যাকৃত ব্যক্তি কিয়ামতের দিবসে হত্যাকারীর মাথার অগ্রভাগ নিজ হাতে ধরে এমনভাবে নিয়ে আসবে যে হত্যাকারীর গলার রগসমূহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে। তখন হত্যাকৃত ব্যক্তি এ কথা বলতে বলতে হত্যাকারীকে আরশের কাছে নিয়ে আসবে ‘হে প্রভু! সে আমাকে হত্যা করেছে।” [মুসনাদে আহমদ : ২৫৫১, তিরমিজি : ২৯৫৫]
মানবসমাজে কোনো রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড কোনো বিবেকবান ও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাম্য নয়। সহিংসতা, হত্যা, নৈরাজ্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘাতমুক্ত দেশের প্রয়োজনে ইসলামের শান্তিপ্রিয় মর্মবাণীর আদর্শে জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সময়ের দাবি।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন। নীতিমালা হিসেবে কুরআনুল কারীম নাজিল করেছেন। সঠিক পথ দেখাতে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। সমগ্র সৃষ্টির জীবনযাত্রায় মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছেন। প্রত্যেককেই যার যার অবস্থানে দিয়েছেন যথাযথ অধিকার। অথচ বর্তমান পৃথিবীতে চলছে হত্যাকাণ্ড নামক মহামারী। যার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পৃথিবীর আলো-বাসাত না দেখা শিশু থেকে শুরু করে মৃত্যুর প্রহরগোনা বৃদ্ধরাও। যা মানবতার জন্য বড়ই অমঙ্গলজনক। এ কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। হে আল্লাহ আপনি আপনার সম্মানিত ও মর্যাদাবান জাতি মানবতাকে হিফাযত করুন। আমীন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নফস, রুহ, কলব......পরিচয়, ব্যাধি, প্রতিকার

চৌদ্দশ বছরের আমরা এক কাফেলা

হাদিস ছাড়া শুধু কুরআন অনুসরণ কতটুকু যৌক্তিক