সমাজকে উন্নত হতে হলে তিনটি প্রধান চালিকাশক্তি অর্জন করা জরুরী

  
ইসলাম উন্নয়নের পরিপূর্ণ সহায়ক শক্তি এবং ইসলাম বিভিন্ন সঠিক কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে প্রকৃত উন্নয়নের দিকে আহবান জানায়৷ চিন্তাবিদরা মনে করেন কোনো সমাজকে উন্নত হতে হলে তার জন্যে তিনটি প্রধান চালিকাশক্তি অর্জন করা জরুরী ৷ এ চালিকাশক্তিগুলো হলোঃ ধর্ম, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার ৷ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিশেষ করে বৃহৎ ধর্মগুলোর আবির্ভাবের পর থেকে এ
তিনটি মূল লক্ষ্য অর্জন ছিল মানবজাতির বৃহত্তম আকাঙক্ষা৷ যুগে যুগে এ লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্যে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে৷ এসব প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছে যখন সারা বিশ্বে সত্য ধর্ম বিস্তৃত হবে, সেদিন মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রে উন্নতি ও পূর্ণতা অর্জিত হবে এবং সব মানুষ আশ্রয় পাবে সামাজিক সুবিচারের শীতল ছায়াতলে৷ এ তিনটি চালিকাশক্তি অর্থাৎ ধর্ম, উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার মানব সমাজে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন বা সুষম অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ৷ আর এ তিনটি চালিকাশক্তি বা নীতিমালার যে কোনো একটি থেকে দূরে থাকলে সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভিত্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷

ইসলামের বিধিবিধানগুলো সুস্পষ্ট এবং সব দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ এ ধর্ম মানুষের প্রকৃতি ও বিবেকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ৷ মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব চাহিদা সৃষ্টি হয় সেগুলো পূরণের জন্যে ইসলামে রয়েছে কাঙিক্ষত কর্মসূচি ও পরিকল্পনা৷ এ ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো বস্তুগত ক্ষেত্র ও মানুষের শারীরীক বা জৈবিক চাহিদার ক্ষেত্র৷ ইসলাম এ দুটি ক্ষেত্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে৷ ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃতির জগত এবং এর বহিপ্রকাশগুলো তথা মানুষের পার্থিব জীবন মানুষের পূর্ণতা অর্জনের একটি উপয্‌ক্তু মাধ্যম৷ এ জন্যেই ইসলাম একদিকে পৃথিবীকে ধন ও ধান্যে সমৃদ্ধ বা আবাদ করতে বলে এবং অন্যদিকে পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারও নির্দেশ দিয়েছে৷ ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া এবং এ প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সমস্ত দিকের উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হয়৷ উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী চিন্তার একটি গরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো ইসলাম একইসাথে মানুষের ইহকালীন ও পারলৌকিক জীবনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে৷ উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদের সাথে এ সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর মূল পার্থক্য ঠিক এটাই৷
আপনারা নিশ্চই এটা জানেন যে, বর্তমান বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বা বিজয়ী সভ্যতা সব কিছুকেই বস্তুগত বা দুনিয়ার লাভ লোকসানের ভিত্তিতে বিচার করে থাকে৷ রুটি রুজির সমস্যা ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করা মানুষের জীবনের জন্যে খুবই জরুরী৷ কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনের উন্নতি বা উন্নয়ন একমুখি হওয়া উচিত নয়৷ পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে উন্নয়ন বলতে কেবল ভোগ ও মুনাফা অর্জনকেই বোঝায়৷ পাশ্চাত্য সেখানকার তথাকথিত পুনর্জাগরণ বা রেনেসাঁর পর ভোগবাদী ও মুনাফাকামী নীতি গ্রহণ করে এবং মানুষকে চরম ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়া হয়৷ এ বিষয়টি অর্থনৈতিক তৎপরতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে৷ পাশ্চাত্যের উন্নয়ন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীতে মানুষের বৈষয়িক চাহিদাগুলো মেটানোর ক্ষেত্রে চরমপন্থা গৃহীত হওয়ায় ভোগবাদ লাগামহীনভাবে বেড়েছে৷ এর ফলে অনেক কৃত্রিম বা অপ্রয়োজনীয় চাহিদাও সৃষ্টি করা হয়েছে৷ আর এই চরমপন্থা বা বাড়াবাড়ি বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে৷ এ প্রসঙ্গে একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ খুবই যথার্থ মন্তব্য করেছেন৷ মার্কিন সমাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বর্তমান সভ্যতায় আমরা এমন এক কাল্পনিক ও মিথ্যা জগতে বসবাস করছি যা সাজানো হয়েছে শুস্ক বা নীরস কৃত্রিম ফুল ও বিনোদনের জন্যে বিভিন্ন কক্ষ নির্মানের মধ্য দিয়ে৷ অথচ আমাদের মনগুলো হয়ে গেছে অনুভূতিশূণ্য এবং আমাদের অন্তরগুলোকে ক্যাফেইন, কফি ও অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় বা মদ পানের মাধ্যমে মাদকাসক্ত করা হয়েছে৷ পাশ্চাত্যের উন্নয়ন মডেলে যান্ত্রিকতাবাদ বা মেশিনিজমের মোকাবেলায় মানুষের মর্যাদা ও ইচছাকে গুরুত্ব দেয়া হয় নি৷ এটাই উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে পশ্চিমা উন্নয়ন মডেলের প্রধান বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য৷ ইসলামে অর্থনীতি ও উন্নয়নকে নৈতিকতার সাথে সমন্বিত করা হয়েছে৷ ফলে ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক তৎপরতাগুলো হয় লক্ষ্যপূর্ণ ও যৌক্তিক৷ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ধনসম্পদ বা অর্থকড়ি কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য ও উৎপাদন-তৎপরতা যেন মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন না করে ৷ সূরা নূরের ৩৭ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ এরা সেইসব লোক যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং নামাজ কায়েম ও যাকাত দান হতে বিরত রাখতে পারে না ৷
আয়াতে এমন লোকদের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে যাদের বৈধ বা ইতিবাচক অর্থনৈতিক তৎপরতা তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখে না৷ এটা স্পষ্ট যে যারা মহান আল্লাহকে সব সময় স্মরণ রাখে তারা অর্থনৈতিক তৎপরতাসহ যে কোনো কাজেই জুলুম, প্রতারণা এবং দূর্নীতি থেকে দূরে থাকে৷ এ ধরনের লোকদের জন্যে সব সময় সৌভাগ্য বা সুফল অপেক্ষা করে৷
ইসলামের উন্নয়ন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গীর আরেকটি মূল কথা হলো ন্যায়বিচার৷ ইসলাম মনে করে, ন্যায়বিচারবোধ বা প্রকৃত ন্যায়বিচার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের অসঙ্গতি বা সমস্যাগুলোকে যত বেশি সংশোধন করতে পারে অন্য কোনো বিষয় বা চেতনা ততটা করতে সক্ষম নয়৷ ন্যায় বিচারের ধারণা না থাকার কারণেই সমাজে সব ধরনের দূর্নীতি ও সামাজিক সংকট দেখা দেয়৷
হিংসতা, জুলুম, নিরাপত্তাহীনতা, মানসিক অস্থিরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার মতো সংকটগুলোর মূল উৎস হচ্ছে অবিচার বা অন্যায়৷ অবিচারের প্রভাবগুলো পশ্চিমা জড়বাদী সমাজেও খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যদিও পশ্চিমা জড়বাদী সভ্যতা নিজেকে জনকল্যাণ ও স্বাধীনতা বা মুক্তির ধবজাধারী বলে দাবী করে৷ বর্তমানে পাশ্চাত্যে ক্ষমতাসীন মহলের স্বার্থপূজা ও বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের বেদীতে ন্যায়বিচার বিসর্জিত হয়েছে৷ পশ্চিমা সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এতো বেশী প্রকট যে বর্তমানে তারা অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে এবং খোদ পশ্চিমা জনগণই এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানাচেছ৷ পশ্চিমা সমাজের উন্নয়ন পদ্ধতির কারণে সেখানে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে এবং সেখানকার সম্পদ বন্টণ পদ্ধতিতে ব্যবধান ও অবিচার খুব ভালোভাবেই স্পষ্ট৷ পুঁজিবাদী দেশগুলোতে অল্পসংখ্যক পুঁজিপতি রাষ্ট্রক্ষমতার মূল কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷ এসব দেশে কলকারখানার মালিকরা এবং অন্যান্য সম্পদশালী ব্যক্তিত্ব শুধু তাদের স্বার্থ হাসিল বা মুনাফা বৃদ্ধির চিন্তায় মশগুল থাকেন৷ এ প্রসঙ্গে ফরাসী অর্থনীতিবিদ জ্যাক্স বলেছেন,উত্তরাঞ্চলের ধনী দেশগুলো প্রাচুর্যের সময়ও বেকারত্ব, দারিদ্র দূর করতে এবং সামাজিক সেবার বিপুল ব্যায়ভার বহন করতে সক্ষম নয়৷ দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা দেশগুলো উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর লুন্ঠন ঠেকাতে অক্ষম ৷ এই দেশগুলো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষা বা দূষণ ঠেকানোর প্রতিও কোনো লক্ষ্য রাখছে না ৷ অন্যদিকে ইসলাম ন্যায়বিচারকে উন্নয়নের সহযোগী বলে মনে করে ৷ ইসলামের অর্থনৈতিক পদ্ধতিটাই এমন যে এ পদ্ধতির লক্ষ্য ও নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সহজ হয় ৷  

অন্য কথায় ইসলামের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ও উন্নয়ন সংক্রান্ত লক্ষ্যগুলোর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব৷ ইসলামের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালার অন্যতম প্রধান
ইসলামে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও কর্মসূচির লক্ষ্য হলো মানুষের মর্যাদা এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলো রক্ষা করা ৷ ইসলামে উন্নয়নের বিষয়টি ব্যাপক অর্থবোধক ও বিস্তৃত এবং নৈতিক বিভিন্ন দিকসহ আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত দিকগুলোও এর সাথে য্‌ক্তু৷ ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন শুধু বস্তুগত বিষয় নয়, আর এটাই উন্নয়ন সম্পর্কে ইসলামের সবচেয়ে স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য যাকে পশ্চিমা উন্নয়ন মডেলের বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে সহজেই পৃথক করা যায়৷ পুঁজিবাদী সমাজ শুধু মুনাফাকামিতা ও বস্তুগত চাহিদা পূরণকেই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য বলে মনে করে কিন্তু ইসলাম গঠনমূলক উৎপাদনের পাশাপাশি মানবীয় মূল্যবোধগুলো রক্ষা করাকেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে মনে করে৷ সবক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেলের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি৷ ইসলাম ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষকে উন্নত করা৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়৷ অর্থনীতি এ উচচতর লক্ষ্যে পৌঁছার একটি মাধ্যম৷ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এটাও বলেছেন যে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যেই নবী রাসূলগণকে পাঠানো হয়েছে৷ পবিত্র ধর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার মানুষের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ অবিচার বা জুলুম সমাজের শৃঙখলা ও ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে৷ অবিচার সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিরাজিত সুস্থ সম্পর্ক এবং নীতিমালাকে নড়বড়ে করে তোলে৷ আর এ কারণেই ইসলাম ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে বলে৷ একমাত্র ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার মাধ্যমে সমাজে কাঙিক্ষত উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব৷ কাঙিক্ষত উন্নয়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবনের সব ক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণতা অর্জিত হয়৷ অর্থাৎ এ পূর্ণতা মানুষের বস্তুগত, আধ্যাত্মিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ তার জীবনের সব ক্ষেত্রেই অর্জিত হওয়া উচিত৷
ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের বিশেষ অর্থ রয়েছে৷ সম্পদের সুষম বন্টন এবং উৎপাদন ও সেবার খাতে প্রাথমিক সুবিধাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান দ্রব্যগুলোর সমবন্টন এই ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত৷ প্রাকৃতিক সম্পদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সমানভাবে জনগণের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুস্থ থাকে৷ এ সম্পদগুলো বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তি বা কয়েকটি গোষ্ঠীর একচেটিয়া দখলে থাকলে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য দেখা দেয়৷ ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল৷ প্রথমতঃ সম্পদের ভারসাম্য এবং দ্বিতীয়ত জনকল্যাণ৷ ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সবারই প্রাপ্য, এমনকি অমুসলমানরাও এ ন্যায়বিচার পাবার অধিকার রাখে৷ ইসলাম মনে করে মানুষের জীবন যাপনের উপকরণগুলো এমনভাবে বন্টিত হওয়া উচিত যাতে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, খাদ্য ও বাসস্থানসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট মাত্রায় সুযোগ সুবিধা পায়৷
ইসলামে জনকল্যাণ অর্থ সমাজের দারিদ্র দুর করা৷ মানব সমাজের অধিকাংশ দুর্গতি বা বিপর্যয়ের উৎস হলো দারিদ্র্য৷ দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতের কারণে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মতো বিভিন্ন অপরাধ দানা বাঁধতে থাকে৷ ইসলাম বাধ্যতামূলক দান ও স্বেচছায় দান করাকে জনকল্যাণের একটি পন্থা বলে মনে করে৷ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন৷ যেমন- সূরা যারিয়াতের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের ধনসম্পদে বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্তের যে হক রয়েছে তা তারা আদায় করতো৷" এ থেকে বোঝা যায় ধনী মানুষের ধন সম্পত্তিতে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে৷ এছাড়াও হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনায় দরিদ্র বা বঞ্চিতদের সাহায্য করার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ এসব বর্ণনায় দেখা যায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর পবিত্র বংশে জন্মগ্রহণকারী ইমামগণ দরিদ্র ও বঞ্চিতদের ব্যাপকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন৷ আর এ থেকে বোঝা যায় অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে জনকল্যাণ জরুরী৷ মহানবী (সাঃ)'র আহলে বাইত বা তাঁর পবিত্র বংশে জন্মগ্রহণকারী ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, দরিদ্র ব্যক্তিকে এতোটা পরিমাণে দেয়া দরকার যাতে সে পানাহার ও পোশাক পরা ছাড়াও বিয়ে করতে পারে এমনকি সদকা দিতে পারে ও হজ্বেও যেতে পারে৷ উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে সম্পদের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণর্ বিষয়৷ ইসলামী সমাজে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় বস্তুগত সামগ্রীর অধিকারী হবার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান বা বৈষম্য থাকা বৈধ নয়৷ যদিও সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকতেই পারে এবং তা অগ্রাহ্য করা যায় না৷ কারণ, সৃষ্টিশীলতা এবং শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার দিক থেকে অথবা কাজ করার দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ ইসলাম এ পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেয়৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলাম সমাজের মানুষের মধ্যে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় বস্তুগত সামগ্রীর অধিকারী হবার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান বা বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেয় না ৷ বরং ইসলাম সম্পদের সমবন্টনের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছে৷ ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজের অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলে তারা খোদাদ্রোহী বা উদ্ধত প্রকৃতির হয়ে পড়বে এবং অন্যদিকে দরিদ্র লোকেরাও দারিদ্র্যের কারণে বিভিন্ন অপরাধ বা অনুপযোগী কাজে জড়িয়ে পড়বে৷
পবিত্র ইসলাম ধর্ম মানুষের অর্থনৈতিক তৎপরতাগুলোর বিরোধী নয়৷ কারণ ইসলাম উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়৷ আর তাই এ পবিত্র ধর্ম মানুষকে কাজ করতে ও চেষ্টা সাধনা করতে বলে যাতে মানুষ কাঙিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হয়, একইসাথে ইসলাম ধনীদেরকে তাদের সম্পদ থেকে দরিদ্রদের দান করতে বলে৷

ইসলামী আইন অনুযায়ী এ দান বাধ্যতামূলক৷ আর এভাবে ইসলাম দান খয়রাতকে সমাজে সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণের বা সম্পদে ভারসাম্য সৃষ্টির অন্যতম পন্থা বলে মনে করে৷ দান খয়রাত করতে উৎসাহ যুগিয়ে ইসলাম সমাজ থেকে দারিদ্র্য ও বঞ্চনা দূর করতে চায় ৷ কারণ দানের অর্থ সম্পদ দিয়ে বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ অর্থনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ পায়৷ তবে এটাও স্পষ্ট যে, ইসলামী সমাজে কেউ দরিদ্র বলে বসে বসে দানের অর্থ সম্পদ ভোগ করবে ইসলাম এমন সুযোগ দেয়ারও পক্ষপাতি নয়৷ আমিরুল, মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করতেন৷ তাঁর মতে, সেই সরকারই সর্বোত্তম সরকার যে সরকার ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে৷ হযরত আলী (আঃ) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন৷ তিনি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাছে লেখা চিঠিতে উন্নয়ন ও অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেছিলেন৷ হযরত আলী (আঃ) তার পক্ষ থেকে মিশরে নিয্‌ক্তু গভর্ণর মালেক আশতারের কাছে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি মানুষের ক্ষমতা বা যোগ্যতা এবং সহনশীলতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের কারণে জনপদগুলো ধবংস হয়ে যায়৷ হযরত আলী (আঃ)' দৃষ্টিতে উন্নয়ন বলতে শুধু ব্যক্তির অর্থ-সম্পদ বা উপার্জন বৃদ্ধিকে বোঝায় না, সম্পদের সমবন্টন, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সম্পদ ভোগ বা ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করাও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ আমিরুল মোমেনিন আলী (আঃ)'র মতে সমাজে যদি কোনো দরিদ্র মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে এবং কোনো ধনী ব্যক্তির সম্পদ বাড়তে থাকে, তাহলে তা হলো দরিদ্রদের সম্পদ লুন্ঠিত হবার ও রাষ্ট্রের সম্পদ সমানভাবে বন্টিত না হবার লক্ষণ৷ মালেক আশতারের কাছে তিনি লিখেছেন, সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ের ও শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, এই গ্রুপ বা শ্রেণীগুলো যে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল তা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে৷ সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে অমুসলিম সম্প্রদায় এবং ব্যবসায়ীসহ দরিদ্র বা দূর্বল ও বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ-এ সব গ্রুপই এক পর্যায়ের নয়৷ মহানবী (সাঃ)র আহলে বাইতের সদস্য আমিরুল মোমেনিন আলী (আঃ)'র মতে, এ সব শ্রেণীরই নির্দিষ্ট কিছু অধিকার রয়েছে, আর এ অধিকারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা শাসকদের কর্তব্য  

ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া ৷ ইসলাম উন্নয়নকে মানুষের বৈষয়িক বা বস্তুগত দিক ছাড়াও আধ্যাত্মিক দিক থেকেও বিবেচনা করে৷ এ কারণে উন্নয়ন সংক্রান্ত অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য রয়েছে৷ খোদামুখিতা ও মানুষের সত্ত্বাগত মূল্যের প্রতি গুরুত্ব উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী নীতিমালার প্রধান বা মৌলিক দিক৷ আর উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী মডেলের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে অর্থনৈতিক তৎপরতা যে কোনো ধরনের দূর্নীতি, প্রতারণা ও অন্যায় থেকে মুক্ত থাকতে পারে৷ এ ছাড়াও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামী উন্নয়ন মডেলের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ মানুষের সম্পদ ও উপার্জন বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনাও উন্নয়ন সম্পর্কিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীর আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য
পরিবেশ রক্ষা ও পরিবেশ দূষণ রোধ করা ইসলামী উন্নয়ন মডেলের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ এছাড়া মানুষের জীবনের জন্যে প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর অস্তিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রায় প্রতি বছর বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে জ্বালানী সম্পদের খনি বা উৎস আবিষ্কার করছে৷ বিশ্বের প্রচলিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবেশ রক্ষা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয় না৷ তাই আজকাল টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে৷ গত শতকের খৃষ্টীয় ৬০ এবং ৭০'র দশককে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্বের ব্যাপারে মানুষের জাগরণের যুগ বলা যায়৷ ঐ সময় থেকে এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ক্রমেই ফুরিয়ে আসার এবং এরইমধ্যে প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হবার বিষয়ে হুঁশিয়ারী উচচারণ করে আসছেন৷ অনেক চিন্তাবিদ বা বিশেষজ্ঞ শিল্পোন্নত দেশগুলোর বৈষম্যমূলক ও লাগামহীন উন্নয়নের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷
বিশ্বের দেশগুলো এখন এ বিষয়ে একমত যে, লাগসই প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশী ফলদায়ক এবং পরিবেশের জন্যও তা সবচেয়ে কম ক্ষতিকর৷ বর্তমানে উন্নত দেশগুলোও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মুখাপেক্ষী৷ কারণ এ ধরনের প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে তেল-গ্যাস বা ফসিল জ্বালানীর মতো অনবায়নযোগ্য জ্বালানী ও সম্পদের উৎসগুলোর ওপর চাপ কম থাকবে কিংবা এসব ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়া যাবে৷
টেকসই প্রযুক্তির সমর্থকদের মতে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অবিচেছদ্য অংশ এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এ বিষয়কে অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত৷ পরিবেশের দিকে লক্ষ্য না রেখে উন্নয়ন তৎপরতা চালানো হলে সে উন্নয়ন টেকসই বা সুদৃঢ় হবে না৷ প্রকৃতি কি শুধুই মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হবার যোগ্য? প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক শুধুই লাগামহীনভাবে প্রকৃতির কাঁচামাল ব্যবহারের সম্পর্ক হতে পারে না৷ তাই এটা স্পষ্ট মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকা দরকার৷ আমরা বর্তমানে দেখছি মানুষ তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী তথ্য, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো অর্জনের তাগিদে পরিবেশকে মানুষের জীবন যাপনের জন্যে সহজতর বা উপযোগী করার পরিবর্তে পরিবেশ ধবংসে মেতে উঠেছে৷ টেকসই উন্নয়নের সমর্থকরা মনে করেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয় দুটির মধ্যে সব সময় একটিকে অপরটির জন্য কোরবানী বা বিসর্জন দিতে হবে- এমনটি মনে করার কোনো যুক্তি নেই৷ কারণ, পরিবেশের মান ভালো থাকলে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হয়৷ আসলে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য একটি বড় ধরনের বিশ্ববিপ্লব ঘটানো জরুরী৷ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার লক্ষ্যেও পরিবেশ সংরক্ষণ জরুরী৷ এভাবে দেখা যায় টেকসই উন্নয়নের ধারণায় প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ব্যবহারকে যৌক্তিক সীমার মধ্যে সীমিত রাখা, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সকলের অংশগ্রহণ এবং জনগণের সহানুভূতি, ন্যায় বিচার ও ভারসাম্য- এসব বিষয় মৌলিক চাহিদা হিসেবে বিবেচিত হয়৷ ইসলামের অর্থনৈতিক শিক্ষায়ও এ ধরনের দিক বা বিষয়গুলো ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে এবং বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনায় সেগুলো ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে৷ ইসলামী বর্ণনাগুলো বিশ্বের সাথে পরিচিত হবার ও বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের পরিচিতির এক প্রধান উৎস৷ এসব বর্ণনা মানুষকে প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দেয়৷ ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃতি মহান আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন বা প্রতিফলন এবং বিশ্বের সব কিছু তাঁরই প্রশংসা করে৷ মহান আল্লাহ তার অপার করুণার কারণে বিশ্বজগতকে মানুষের কল্যাণের জন্য প্রস্তুত করেছেন৷ প্রকৃতির বিস্ময়কর দিকগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা বা গবেষণা আল্লাহর মহত্ত্ব ও শক্তি উপলব্ধির অন্যতম পন্থা৷ মানুষ যাতে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে উন্নতি এবং পূর্ণতা অর্জন করতে পারে সে লক্ষ্যে মহান আল্লাহ আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে তার সবই মানুষের অধীনস্ত বা আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছেন৷ ইসলামী উন্নয়ন মডেল মানুষকে জীবন যাপন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপচয় বা অপব্যয়ের এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে নষ্ট করারও অনুমতি দেয় না৷ পবিত্র কোরআন মুসলমানদেরকে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবন-উপকরণগুলো যৌক্তিক মাত্রায় এবং যথাযথভাবে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে৷ যেমন, মহান আল্লাহ সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তোমরা খাও ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না৷" ইসলামের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ ও ইমামগণ অপচয় করা নিষিদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কে অনেক হাদিস বা রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন৷ যেমন, ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) অপব্যয় পরিহারের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, এমনকি খেজুরের বিচি ফেলে দেয়াটাও এক ধরনের অপব্যয়৷ আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, অর্থনৈতিক সহায়সম্পদ খোদাভীরু বা মোত্তাকী মানুষকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বিচ্যুত করে না এবং সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সে অপব্যয়ী বা সীমালংঘনকারী হয় না৷
ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) তাঁর এক মূল্যবান বাণীতে বলেছেন, খনি ও মূল্যবান সম্পদ অর্জিত হলে মানুষকে সে বিষয়ে বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে৷ চক, চুন, তামা, সীসা, রূপা, চুনি বা রুবি এবং পান্না ও অন্যান্য খনিজ পাথরের খনি পাওয়া গেলে তা সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার করতে হবে৷ মানুষের ব্যবহারের জন্য মাটির নীচে অনেক সম্পদ রয়েছে এবং প্রয়োজন মোতাবেক তা আবিষ্কার করতে হবে ও খনি থেকে উত্তোলন করতে হবে৷ ইসলাম কৃষিকাজ ও বৃক্ষ রোপনের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে এবং কৃষকদেরকে ভূপৃষ্ঠের সম্পদ বলে মর্যাদা দিয়েছে৷ যেসব স্থান শুস্ক বা যে অঞ্চলে গাছ পালার সংখ্যা কম সেসব স্থানে গাছ কাটতেও এ পবিত্র ধর্ম নিষেধ করেছে৷ ইসলাম পরিবেশ দূষণ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি পরিস্কার পরিচছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা এবং প্রকৃতির সুরক্ষা বা প্রকৃতিকে সুস্থ রাখার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে৷ ইসলামী বর্ণনাগুলোতে এ সংক্রান্ত অনেক বাণী দেখা যায়৷ যেমন, আমিরুল মোমিনিন হযরত আলী ( আঃ ) পানিকে বিশেষ করে স্থির পানিকে ঘোলা বা দূষিত না করার উপদেশ দিয়েছেন৷ মানুষ ও বিশ্বসমাজের কাছে ইসলাম এ আহবান তুলে ধরে যে অর্থনৈতিক ও উৎপাদন-তৎপরতা এমনভাবে চালানো উচিত যাতে প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশও অটুট থাকে৷ এভাবে ইসলামের উন্নয়ন মডেল প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও এর গুরুত্ব তুলে ধরেছে৷ ইসলামের এই দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এ পবিত্র ধর্ম প্রাকৃতিক সম্পদকে সব যুগের মানুষের সম্পদ বলে মনে করে৷ ইসলামের নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী এসব সম্পদ সবচেয়ে ভালো পন্থায় ব্যবহার করতে হবে৷ প্রকৃতির সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি ইসলামের নীতিমালা মেনে চলা হয় তাহলে বিশ্বের উন্নয়ন তৎপরতার কারণে কখনোই পরিবেশ দুষণের মতো সংকট দেখা দিবে না৷
 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নফস, রুহ, কলব......পরিচয়, ব্যাধি, প্রতিকার

চৌদ্দশ বছরের আমরা এক কাফেলা

হাদিস ছাড়া শুধু কুরআন অনুসরণ কতটুকু যৌক্তিক