ইন্টারনেট: দ্বীনী খিদমাতের এক উর্বর ক্ষেত্র
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বিশেষত আলেম বা মাদরাসার ছাত্ররা ভাবে আমি ইন্টারনেটে কী করব? আমার কী কাজ? আমার কি দরকার আছে? ইত্যকার প্রয়োজনের জবাব পেতে এই লেখাটি পড়তে ও সংগ্রহে রাখতে পারেন।_______সম্পাদক।
লেখক- ইউসুফ সুলতান।
তরুন আলেম.গবেষক ,সমাজ সেবক।
এক.
ইন্টারনেট আবিস্কারকে গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিস্কার মনে করা হয়। হাজার
মাইলের দূরত্ব ও সময়ের ব্যবধানসহ সবরকম বাধা দূর করে তথ্যের আদান-প্রদানকে
সহজ ও গতিময় করতে এর বিকল্প নেই।
১৯৬০ সনে মার্কিন সামরিক
বাহিনীর গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট্স এজেন্সি বা আরপা
(ARPA) পরীক্ষামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও
গবেষণাগারের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে
তৈরি করা এই নেটওয়ার্ক আরপানেট নামে পরিচিত ছিল। এরই বাণিজ্যিক সংস্করণ
ইন্টারনেট। ১৯৯০ এর পরের দিকে যার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। (সূত্র :
উইকিপিডিয়া)
ইন্টারনেটের প্রাথমিক ব্যবহারটা ই-মেইল
আদান-প্রদানেই অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল। একসময় ব্যবহারকারীরা নিজেদের পরিচিতি
অন্যান্য সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করে।
জন্ম হয় ওয়েবসাইটের।
ইন্টারনেট আবিস্কারের পরই শুরু হয়
ব্যক্তিগত, সামাজিক, ব্যবসায়িক ও রাষ্ট্রীয় নানা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট।
ওয়েবসাইটকে সহজে “ইন্টারনেটভিত্তিক ঠিকানা” বলে ব্যক্ত করা যেতে পারে।
একেকটি ওয়েবসাইটে একটি ডোমেইনের অধীনে হাজারো পাতার সমষ্টি হতে পারে।
ডোমেইন হলো ওয়েব ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত নামটি। বাস্তব পৃথিবীতে যেমন
প্রত্যেকের বাড়ীর একটি হাউজিং নম্বর থাকে, যা দিয়ে তাকে চিহ্নিত করা
যায়, ডোমেইন ঠিক সেরকম। যেমন, ইসলাম-ডট-কম একটি ডোমেইন। এর অধীনের হাজারো
পাতার সমষ্টিতে একটি ওয়েবসাইট।
নানা রকম ওয়েবসাইটের একটি প্রকার
ব্লগ। ব্লগ শব্দটি ওয়েব ও লগ শব্দদ্বয়ের সন্ধি। এর অর্থ অনলাইন দিনলিপি।
কিন্তু বর্তমানে শুধু দিনলিপি নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়
ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় ব্লগে স্থান পায়। ব্লগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
বৈশিষ্ট্য হলো, নানা মতের মানুষ লেখক বা ব্লগারের লেখার ওপর তাৎক্ষণিক
প্রতিক্রিয়া ও মতামত জানাতে পারে। যা আর কোনো গণমাধ্যমে সম্ভব নয়।
দুই.
২০১১ সনের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইন্টারনেটে মোট রেজিস্ট্রিকৃত
ডোমেইনের সংখ্যা ৫৫ কোটি। ২০০৮ এ যা ছিল মাত্র ১৮ কোটি বিশ লক্ষ। (সূত্র:
staticbrain.com) আর একেকটি ডোমেইনের অধীনে থাকতে পারে হাজারো পাতা। তাই
সর্বমোট পাতার সংখ্যা বলা মুশকিল।
১৯৯৫ সনের ডিসেম্বরে বিশ্বের
মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ১ কোটি ৬০ লক্ষ্য, যা পৃথিবীর মোট
জনসংখ্যার মাত্র ০.৪ শতাংশ। আর ২০১১ সনের মার্চ মাসে এ সংখ্যা গিয়ে
দাঁড়ায় দুই শত নয় কোটি পঞ্চাশ লক্ষ্যে। যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৩০.২
শতাংশ। (সূত্র : internetworldstats.com)
২০১২ সনের একটি
পরিসংখ্যানে এশিয়াতে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেখানো হয়েছে প্রায় ১০৭৭
মিলিয়ন বা প্রায় ১০৮ কোটি। যা ২০১০ এ ছিল ৮২৫ মিলিয়ন বা ৮৩ কোটি। ২০১০ এ
বাংলাদেশে মোট ফেইসবুক ব্যবহারকারী ছিল প্রায় দশ লক্ষ। যা ২০১২ তে বেড়ে
দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ লক্ষে। আর একই সময়ে বাংলাদেশে মোট ইন্টারনেট
ব্যবহারকারী প্রায় আশি লক্ষ। (সূত্র: internetworldstats.com)
উপরোক্ত পরিসংখ্যানগুলো খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয় যে, ওয়েবসাইট ও ইন্টারনেট
ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার যে কোনো গাণিতিক হারকেও হার মানায়। খোদ
বাংলাদেশেও এই হার উর্ধ্বমুখী। যা আগামী বছরগুলোতে আরো দ্রুত বৃদ্ধি পাবে
বলে আশা করা যায়। আগামীতে একেকজন মোবাইল ব্যবহারকারীই হবেন একেকজন
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
তিন.
সম্পূর্ণ বাংলা
ভাষায় অনলাইনে প্রথম ব্লগ চালু হয় ২০০৫ এ। ২০০৬ থেকে মোটামুটি তা
জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। বাংলা ভাষায় ব্লগ চালু হওয়ার পর তা মূলত
বিভিন্ন সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী, নবীন কবি, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের
ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে বাংলা ব্লগ ইতিহাসের শুরু
থেকেই ইসলাম বিদ্বেষী লেখার দৌরাত্ম লক্ষণীয়। জনপ্রিয়তা ও হিট (ব্লগের
ভিজিট সংখ্যা) বাড়ানোর জন্য অনেকেই তখন ইসলাম বিরোধী ব্লগ লেখা শুরু করে।
দেখা যায়, গঠনমূলক কোনো লেখা দিলে তাতে মন্তব্য পাওয়া যায় হাতে গোনা
কয়েকটি। আর ইসলাম বিরোধী ব্লগ লিখলে তাতে মন্তব্য-উত্তর ও নানা
তর্ক-বিতর্ক মিলিয়ে মন্তব্য ছাড়িয়ে যায় শতককে।
এভাবেই জন্ম
হয় বেশ কিছু তরুণ স্বঘোষিত নাস্তিকের। যারা নিজেদের নাস্তিক পরিচয় দিয়ে
তৃপ্তি পায় এবং নাস্তিকতার আড়ালে মূলত ইসলামের কুৎসা রটায়। বিশেষ করে
ইসলামের নবী মুহাম্মাদ স. এঁর পারিবারিক জীবন নিয়ে যাচ্ছেতা লিখতে থাকে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্লগগুলোর সঞ্চালকদের এসব লেখার বিষয়ে তেমন কোনো
পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তা হয়ত তাদের ব্লগে হিট বাড়ানো জন্য,নতুবা
নিজ মতাদর্শের অভিন্নতার জন্য।
নব্য নাস্তিক পরিচয়ধারী এসব
ব্লগাররা পরবর্তীতে আরো নতুন কিছু বাংলা ব্লগ সাইট খুলে। এবং এগুলোর
কয়েকটি শুধু ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে অশ্লীলতা ছড়ানোর জন্যই। সেসব সাইটে
আজ থেকে বছর তিনেক আগে নবীজী স. কে অপমান করে প্রকাশ করে অশ্লীল কমিক ই-বই।
যেগুলো বছরের পর বছর পড়া হয় ও ডাউনলোড করা হয়।
এছাড়া অন্য
ব্লগগুলোতেও তুলনামূলক ইসলাম বিরোধী লেখা বেশি প্রকাশ হয়। যারা এসবের
বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে অনেক সময় সঞ্চালকবৃন্দ ব্যান (ব্লগ বা মন্তব্য
প্রকাশ করার অধিকার হরণ) করেন। মুক্ত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার ছায়াতলে
এসব নাস্তিকদের সহযোগিতা করে যান।
আর যখন এগুলোর কোনো উত্তর দেয়া
হয়, তখন একের পর অশ্লীল গালাগালি করে উত্তরদাতাকে হেনস্থা করা হয়। এবং
“ছাগু” সহ বহু অশ্লীল উপাধি দেয়া হয়। ফলে এক শ্রেণীর পাঠক, যারা নীরবে
পাঠ শেষে চলে যান, তারা হৃদয়ে নিয়ে যান ইসলাম নিয়ে অনেক সন্দেহ। ধীরে
ধীরে এসব সন্দেহ তাদেরকে ঈমান ছাড়া করে।
চার.
ইন্টারনেটে ইসলাম বিদ্বেষ নতুন নয়। প্রায় আট-দশ কিছু একটা খুঁজতে গিয়েই
একদিন আলী সীনা নামের এক ব্যক্তির ওয়েবসাইটের সাথে পরিচিত হই। নিজেকে
তিনি এক্স মুসলিম বা পূর্বে মুসলিম ছিলেন বলে দাবী করেন। এবং আরো দাবী করেন
যে, তিনি পরবর্তীতে খ্রীস্টান হয়ে গেছেন ইসলামের প্রতি নিরুৎসাহী হয়ে।
ফেইথফ্রীডম বা মুক্তবিশ্বাস নামে তার নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট আছে। নিজেকে
আরবের বাসিন্দা বলেও দাবী করেন তিনি।
তার সেই সাইটটিতে মুসলিমদের
প্রতি মোট এগারো কি বারোটি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া ছিল। সবগুলোই প্রিয় নবীজীর
স. জীবনকে কেন্দ্র করে। রাসূলের স. বিভিন্ন বিবাহ এবং উম্মাহাতুল মুমিনীন
রা. নিয়ে ছিল প্রশ্নগুলো।
সাইটের ব্যানারে লেখা আছে, “যদি কোনো
মুসলিম আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন, তাহলে আমি আমার সাইট মুছে ফেলব”।
আপাৎদৃষ্টিতে যা খুব নিরীহ একটি ব্যানার ও আবেদন।
আলী সীনার
প্রশ্নের জবাবে ইংরেজী ও আরবীতে বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট হয়েছে। এবং অনেক
উলামা তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু তার একই কথা, উত্তর যথার্থ
হয়নি। অনেকটা “বিচার মানি, তালগাছ আমার” –এর মত।
এমনকী, তাকে
সরাসরি বাহাসে আসতেও আহ্বান জানানো হয়েছে। সে রাজী হয়নি। তাকে ফোনে বা
অনলাইনে কথা বলতে আহ্বান করা হয়েছে। সেটাতেও সে রাজী হয়নি। পরবর্তীতে
ডা.জাকির নায়েকও তাকে কনফারেন্সে আহ্বান করেছেন। কিন্তু তাও সে রাজী
হয়নি। মূলত আলী সীনার নাম আসল কিনা, তাও সে কখনো স্পষ্ট করেনি।
এর অনেকদিন পর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তার বিভিন্ন লেখা থেকে সংগৃহীত প্রমাণ
দেখতে পাই যে, সে আসলে একজন ইহুদী, যে কখনোই মুসলিম ছিল না। ২০০৮ এ
ইসরাইলের জেরুলাম পোস্ট নামের সংবাদপত্র তার একটি সাক্ষাৎকার ছাপে। যেখানে
সে বলে, “ইসলামকে সংস্কার করার একমাত্র উপায় হলো, কুরআনকে নিক্ষেপ করা; এর
নব্বই শতাংশই নিক্ষেপ করা উচিৎ। আপনাকে ইসলামের ইতিহাসকেও ছুড়ে ফেলতে
হবে; আর সীরাতকে ছুড়ে ফেলতে হবে পুরো একশত ভাগ।“ (সূত্র: Jerusalem Post,
2008)
মূলত মুসলিমদের মাঝে দ্বীন নিয়ে নানাবিধ সন্দেহ ঢুকিয়ে
দেয়ার জন্যই এ কাজ করছে সে। বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে, আলী সীনা কোনো
ব্যক্তি নয়, আলী সীনা একটি গ্যাং। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করাই যাদের লক্ষ্য।
অবশ্য আলী সীনা ব্যক্তি বা গ্যাং যা-ই হোক, তারা একা নয়। সম্প্রতি
সেন্টার অফ আমেরিকান প্রোগ্রেস নামের একটি বেসরকারী আমেরিকান গবেষণা
সংস্থার রিপোর্টে উঠে আসে আরো ভয়াবহ তথ্য। “দ্যা রুটস অফ ইসলামোফোবিয়া
নেটওয়ার্ক ইন আমেরিকা” বা “আমেরিকায় ইসলামবিদ্বেষী নেটওয়ার্কের গোড়া”
শিরোনামে তারা শতাধিক পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রকাশ করে।
এতে উঠে
আসে যে, আমেরিকার বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন
ডলার অনুদান প্রদান করে কিছু গবেষণা সংস্থাকে। যাদের একমাত্র কাজই হলো
ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো। এসব সংস্থার গবেষণা দলে রয়েছে স্কলার, সম্পাদক ও
প্রচারক। বিধর্মী নারী পুরুষের সমন্বিত স্কলারবৃন্দ ইসলামের কুরআন-হাদীস
অধ্যয়ন করে ইসলাম বিরোধী তথ্য বানিয়ে থাকে। সম্পাদক টিমের হাতে সম্পাদনা
হয়ে প্রচার টিমের মাধ্যমে সেগুলো প্রচার পায়। এই টিমে বেশ কয়েকজন
মিস-ইনফরমেশন-এক্সপার্ট বা ভুল তথ্যবিশারদ রয়েছে, যারা এরকম ভুল তথ্য তৈরী
করে থাকেন।
বিশ্বের নানা জায়গায় কোনো দুর্ঘটনা হলেই তারা
সেগুলো মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে সংবাদ তৈরী করে। তাদের নেটওয়ার্কে কিছু বড়
বড় সংবাদ মাধ্যম আছে। তারা সেগুলো প্রকাশ করে। আবার তাদের সাথে আমেরিকার
বিভিন্ন পার্টির কিছু সংসদ সদস্যও আছে। যারা সেগুলো নিয়ে সংসদেও ঝড়
তোলেন। আবার কিছু তৃণমূল সংগঠন আছে, মানবাধিকার সংগঠনের মতো। তারা সেসব ভুল
তথ্যগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। সাথে কিছু ধর্মীয় সংগঠনও এসব
তথ্য ব্যবহার করে ধর্মীয় আবেগকে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়।
একই তথ্য যখন বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ায় প্রকাশ পায়, বিশ্বের সবচেয়ে
উন্নত দেশের পার্লামেন্টে আলোচিত হয়, সেখানকার মানবাধিকার ও ধর্মীয়
সংগঠনগুলো উচ্চারণ করে, তখন বহু মিথ্যাও সাধারণ মানুষের কাছে সত্য হয়ে
উঠে। আর বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া লুফে নেয় সেসব সংবাদ। তৈরী হয় ইসলামের
প্রতি চরম বিদ্বেষ।
আমেরিকাভিত্তিক এই গবেষণাসংস্থাটি রিপোর্টের
শেষে উল্লেখ করে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামবিদ্বেষ আমেরিকার নাগরিকদের
জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার খাতিরেই তারা এ
বিষয়ে গবেষণা করে প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, গবেষণা টিমটি কোনো মুসলিমদের
নয়। (সূত্র: americanprogress.org)
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে,
বাংলা ভাষায় যারা ইন্টারনেটে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ায়, তারা কোনো না কোনো ভাবে
এদের সাথে সম্পৃক্ত। বহু লেখকের প্রোফাইলে গিয়ে আলী সীনার সাথে সম্পর্ক
খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের লেখাগুলোই অনুবাদ করে বাংলায় তারা প্রকাশ করেন
মাত্র।
পাঁচ.
বাংলাদেশে মুসলিমদের মধ্যে যারা
ধার্মিক, নাস্তিকদের প্রচার সাধারণত তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তবে
যারা সাধারণ মুসলিম, নাস্তিকদের লেখা তাদের সংশয়বাদী করে তোলে। সংশয় থেকে
ধীরে ধীরে ঈমানহীনতা তৈরি হয়।
নাস্তিকদের যেসব লেখা অশ্লীল
গালিগালাজ, সেগুলো সাধারণত তেমন ক্ষতিকারক নয়। তবে যেগুলো কুরআন-হাদীসের
সূত্রসহ দেয়া হয়, সেগুলো সাধারণ মুসলিমদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। যখন
তারা দেখে যে, এসবের কোনো উপযুক্ত উত্তর দেয়া হয় নি, তখন তারা ভাবতে শুরু
করে যে, নাস্তিকদের দাবীগুলোই সত্য।
এ ক্ষেত্রে উলামায়ে কিরামের
অবদানের কোনো বিকল্প নেই। নাস্তিকদের রেফারেন্সগুলো মূলত আগ-পিছ বাদ দিয়ে
বা মাঝ থেকে তুলে ধরা। যেগুলো কেবল উলামায়ে কিরাম উত্তর দিতে পারেন। তাই
অনলাইনে ব্লগসমূহে উলামায়ে কিরামের ব্যাপক অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
অনলাইনে ব্লগ লেখা এবং অনাগত অনলাইনের নানা ফিৎনা বুঝা ও মুকাবেলা করার
জন্য তাই উলামায়ে কিরামকে প্রযুক্তি বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এ
ছাড়া যে কোনো ফিৎনার মূল জানা ও পড়াশোনার জন্য ইংরেজীর কোনো বিকল্প নেই।
তাই মাদ্রাসার নেসাবে কম্পিউটার শিক্ষা ও ইংরেজী কথন, লিখন ও বুঝার
যোগ্যতা অর্জন হয় এমন বিষয় সংযোজন করা অতীব প্রয়োজন। কওমী
মাদ্রাসাসমূহের বোর্ডগুলো এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে বিষয়টা সহজ হতে পারে।
সংস্কার কঠিন হতে পারে, কিন্তু সংযোজন তেমন কঠিন নয়।
প্রতিটি
মাদ্রাসায় একটি কম্পিউটার ল্যাব ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকা উচিৎ। মাদ্রাসার
নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকা উচিৎ। ওয়েবসাইটে ছাত্র, উস্তায সবাই লেখা প্রকাশ
করবে। এছাড়া উস্তাযদের বয়ান, প্রকাশিত বই ইত্যাদিও আপলোড করা হবে। ফতোয়া
বিভাগগুলো অনলাইনে ফতোয়া দিবে। তাহলে সাধারণ মুসলিমরা ব্যাপকভাবে উপকৃত
হবেন।
এছাড়া লেখক, মাওলানা, মুহাদ্দিস, মুফতী, খতীব, বক্তা ও
ওয়ায়েয –প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থাকা উচিৎ। আরবের প্রায়
প্রত্যেক আলেমেরই ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট আছে।
নাস্তিকদের অপরাধের
জবাবে গণআন্দোলন একটি সচেতনতার শুরু হতে পারে। কিন্তু তা বাস্তবে রূপায়ণ
করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।
ছয়.
বাংলা ভাষায় ইসলামিক ওয়েবসাইটের শুরু কবে হয়েছে তা বলা কঠিন।
Islamhouse.com এর বাংলা বিভাগটাকেই সবচেয়ে পুরনো বাংলা ইসলামিক সাইট বলে
মনে হয়। তবে Islam.com.bd -এর রেজিস্ট্রেশন হয় ২০০৬ এ। ডট বিডির যাত্রা
তখন প্রথম দিকে। এরও আগে ২০০৫ এ রেজিস্ট্রেশন করা হয় banglakitab.com
সাইটটি। যাতে বিভিন্ন ইসলামিক বই স্ক্যান করে আপলোড করা হত, এখনও করা হয়।
জনপ্রিয় ইসলামিক ম্যাগাজিন মাসিক মদীনার সাইট mashikmadina.com এর
রেজিস্ট্রেশন হয় ২০০১ এ। ওয়েব আর্কাইভে দেখা সে সময়ের সাইটটিকে বেশ
মানসম্মত বলেই মনে হয়। অবশ্য বর্তমানে ডোমেইনটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। মাসিক
মদীনার সাইটের আগে আর কোনো বাংলা ইসলামিক সাইটের অস্তিত্ব নজরে আসেনি।
(সূত্র : who.is এবং web.archive.org)
ইন্টারনেটে ইসলাম প্রচারের
ক্ষেত্রটি খুব উর্বর। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ধরা
যাক, কোনো সম্মানিত খতীব সাহেব মসজিদে জুমার বয়ান করছেন। তাঁর বয়ান
সর্বোচ্চ এক হাজার মানুষ শুনলেন। এই শ্রোতারা মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর
অনেকেই হয়ত ভুলে যাবেন কী আলোচনা হয়েছে। কিংবা অন্যকে এ বিষয়ে জানাতে
চাইলেও জানানোর সঠিক পথ পাবেন না।
খতীব সাহেব যদি এই একই বয়ান
পেশ করার সময় রেকর্ড করে নেন, পরবর্তীতে নিজস্ব ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ
করেন, তাহলে তা পৌঁছে যেতে পারে অসংখ্য মানুষের কাছে। এবং বয়ানের আবেদন
বেঁচে থাকবে বছর বছর। “অসংখ্য” বলতে হল এ জন্য যে, আসলেই তা সংখ্যায়
সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়।
ধরুন, খতীব সাহেবের বয়ানটি তার
ওয়েবসাইট থেকে এক ভাই শুনলেন। তার ভালো লাগল। তিনি তার ফেইসবুকে তা শেয়ার
করলেন। কিংবা কেবল লাইক দিলেন। তার বন্ধু শত শত। তাদের মধ্যে কারো পছন্দ
হলো। তিনিও লাইক দিলেন বা শেয়ার করলেন। তার বন্ধুদের কারো আবার পছন্দ হয়ে
গেল। এভাবে এটা ঠিক কত হাজার বা লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে, তা ঠিক
হিসাব করা সম্ভব নয়।
এটাতো শুধু ফেইসবুকের কথা বলা হলো।
ফেইসবুকের শেয়ারকারীদের মাঝে কারো পছন্দ হলে তিনি তা ইউটিউবে আপলোড করে
দিবেন। ইউটিউব যেহেতু গুগলের প্রতিষ্ঠান, তাই সার্চ রেজাল্ট বা ইন্টারনেটে
কোনো বিষয় খোঁজার ফলাফলে ইউটিউবের ফলাফলগুলো অগ্রাধিকার পায়।
উদাহরণস্বরূপ খতীব সাহেবের বয়ানের বিষয় ছিল “এপ্রিল ফুল”। তো, বয়ানটি
ইউটিউবে আসার পর কেউ গুগলে খুঁজলে তা প্রথম দিকে চলে আসবে।
ইউটিউব
থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে কোন ফাইল কপি করে নেয় শত শত ওয়েবসাইট। ইউটিউবে
কোনো কিছু আসা মানে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরো শত শত ওয়েবসাইটে চলে যাবে।
খতীব সাহেবের ফেইসুব যদি টুইটারে সংযুক্ত থাকে, তাহলে তা টুইটারেও একইভাবে
ঝড় তুলবে। এপ্রিল ফুলের এই বার্তা পৌঁছে যাবে আরো লক্ষ মানুষের কাছে।
গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও।
ফেইসবুক-টুইটার থেকে কোনো পছন্দকারী আবার
তা কোনো ব্লগে প্রকাশ করবেন। এভাবে তা আবার পৌঁছে যাবে অসংখ্য ব্লগ পাঠকের
কাছে। খতীব সাহেব যদি লিংকডইন ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে স্বয়ংক্রিভাবে
ফেইসবুক-টুইটার হয়ে তা লিংকডইনেও পোস্ট হয়ে যাবে। পৌঁছে যাবে বিভিন্ন
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পেশাজীবীদের কাছে। এভাবে এক
বছরেই তা শেষ হবে না। বরং প্রতি বছর যখনই এপ্রিল ফুলের তারিখ ঘনিয়ে আসবে,
আবারও তা সচল হয়ে এভাবে ঘুরবে চক্রের মাধ্যমে।
এর কারণ হলো,
মানুষ এখন অনলাইনেই বেশি পড়তে পছন্দ করেন। বিশেষ করে নিজের বন্ধু বা
আত্মীয় কোনো লেখা বা লিংকে লাইক বা পছন্দ করলে প্রত্যেকেই তা পড়তে আগ্রহী
হন। এটাই সামাজিক গণমাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ার শক্তি। আর এ কারণেই
ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা এত তুঙ্গে।
ফেইসবুক-টুইটারের এই অনলাইন
চক্রের মাধ্যমে যে কোনো বার্তা মুহূর্তেই পৌঁছে দেয়া সম্ভব বিশ্বের যে
কোনো গণমাধ্যমের কাছে। এভাবে বিশ্বকে খুব সহজেই জানিয়ে দেয়া যায় প্রকৃত
সত্য। আর দ্বীনের খিদমত করা যায় কল্পনাতীতভাবে।
সাত.
ইন্টারনেটের বিশাল এ ময়দানে খিদমাতের আরো অসংখ্য ক্ষেত্র বিদ্যমান।
বাস্তব পৃথিবীতে আমরা কোনো খিদমতের চিন্তা করলে নানা সীমাবদ্ধতা সামনে চলে
আসে। কিন্তু ইন্টারনেটে সেগুলো খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। পৃথিবীর
নানা দেশ থেকে পরিচালিত কয়েকটি ইসলামী ওয়েবসাইটের কিছু খিদমাত এখানে তুলে
ধরার চেষ্টা করা হবে।
ক. Askimam.org –এই ওয়েবসাইটটি সাউথ
আফ্রিকার মাদ্রাসা ইনয়ামিয়াহ কর্তৃক পরিচালিত। মুফতী ইবরাহীম দেসায়ী
দেওবন্দী দা.বা. এর তত্ত্বাবধান করছেন। ২০০৪ এ শুরু হওয়া এই ওয়েবসাইটটি
মূলত ফাতওয়ার ওয়েবসাইট। দারুল ইফতা থেকে প্রতিদিনই বেশ কিছু প্রশ্নের
দালীলীক উত্তর প্রদান করা হয় এখানে। ইংরেজী ভাষায় কুরআন-সুন্নাহর দলীলসহ
হানাফী ফিক্বহের দলীল নির্ভর এই ওয়েবসাইটের উত্তরগুলো পৃথিবীর সব ফিক্বহের
অনুসারীদের কাছেই জনপ্রিয়। সাইটটিতে ইংরেজী ভাষায় আকিদা, সালাত, সাওম,
হাজ্জ্ব, যাকাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক বিষয়, ইসলামের ইতিহাস, সীরাত
ইত্যাদি নানা বিষয়ে হাজার হাজার উত্তর রয়েছে।
খ.
darulifta-deoband.org –এই সাইটটি দারুল উলূম দেওবন্দের দারুল ইফতার
ওয়েবসাইট। ২০০৬ এ প্রতিষ্ঠিত এ ওয়েবসাইটটিতে আরবী, উর্দু ও ইংরেজীতে
হাজারো ফাতওয়া রয়েছে।
গ. islamhouse.com – সাইটটি ২০০০ সনে
প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর প্রায় ৫০ টি ভাষায় ইসলামী প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই, অডিও,
ভিডিও ও ফাতওয়া আপলোড করা হয় এতে। সাইটটিতে হাজার হাজার পেইজ রয়েছে।
এবং প্রতি বছরই শত শত মানুষ সাইটটির মাধ্যমে মুসলিম হয় বলে বছর শেষে
বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
ঘ. dorar.net –সাইটটি ইসলামী
জ্ঞানের বিশ্বকোষের মতো। এতে আকিদা, ফিক্বহ, সুনান, তারীখ, বিভিন্ন মিলাল ও
দ্বীন, ফিরাক ইত্যাদি বিষয়ে শত শত প্রবন্ধ ও বই রয়েছে। হাদীস খুঁজতে
দেয়া হলে পূর্ন সূত্রসহ চলে আসে। এমন আরো নানাবিধ সুবিধা নিয়ে সাইটটি
সাজানো।
এছাড়া আরো হাজারো ওয়েবসাইট আছে, যেগুলোতে বিভিন্নভাবে
ইসলামের খিদমত করা হচ্ছে। ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম, রেডিও,
অডিও-ভিডিও সাইট, কুরআন-সুন্নাহ-ফিক্বহসহ নানা বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ফোরাম,
আলেমদের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ইত্যাদির মাধ্যমে দ্বীনী খিদমাত আঞ্জাম দেয়া
হচ্ছে।
প্রিয় পাঠকদেরকে sultan.org/a সাইটটির সাথে পরিচয় করিয়ে
দিতে চাচ্ছি। এতে বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামী ওয়েবসাইটের সূচী দেয়া আছে।
সাইটগুলো ভিজিট করলে ইন্টারনেটভিত্তিক দ্বীনী খিদমতের পরিকল্পনা করতে
সুবিধা হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই নিয়ামত কাজে লাগিয়ে দ্বীনী খিদমাত করার তাওফীক দিন। আমীন।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন